ট্রান্সট্রোমারের কবিতা: পর্ব- ১

টমাস ট্রান্সট্রোমারের কবিতা অনেকেই অনুবাদ করেছেন, সে-সবের অনেকগুলো তেমন নির্ভরযোগ্য নয়। কারণ কবিতা অনুবাদ করতে গেলে তাতে এমনভাবে আকৃষ্ট হতে হয় তা যেন সেই কবিতার সাথে বসবাস  করার শামিল। তারপর যখন সেই কবিতা শর্তহীন ধরা দেয় অনুবাদকের কাছে, তখনই অনুবাদটা হয়ে ওঠে প্রাণময় । ট্রান্সট্রোমারের কবিতা অনুবাদ করতে গিয়ে নান্নু মাহবুবের ক্ষেত্রে এই ঘটনাই ঘটেছে। আশা করি পাঠক নান্নু মাহবুবের অনুবাদ পড়লেই তা বুঝতে পারবেন। ইতিপূর্বে যাঁরা ট্রান্সট্রোমারের বিভিন্ন কবিতা অনুবাদ করেছেন তাঁরাও মিলিয়ে দেখতে পারবেন নান্নু মাহবুবের অনুবাদ। যাহোক, সাহিত্য ক্যাফে ধারবাহিকভাবে ট্রান্সট্রোমারের প্রায় ৪০টি নান্নু মাহবুব অনূদিত কবিতা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করতে যাচ্ছে। তাই চোখ রাখুন সাহিত্য ক্যাফের পাতায়। ─সাহিত্য ক্যাফে

 

অনুবাদকের কথা

ট্রান্সট্রোমারের কবিতা হলো শূন্যতার কাছে একটি প্রার্থনা। আর তাঁর পৃথিবী একটা অতিজীবিত পৃথিবী, যেখানে সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডটাই সাঙ্গীতিক উজ্জ্বলতায় ভাস্বর। কখনো কখনো অবিশ্বাস্যরকম রঙিন এবং বেশিরভাগটাই স্বপ্ন আর সত্যের একটা আশ্চর্যতরল মিশেল। ট্রান্সট্রোমারের বর্ণনা সিনেম্যাটিক, একই সঙ্গে স্থির এবং তীব্রভাবে গতিশীল। সেখানে হিমতুষার নিঃশ্বাস ফ্যালে মাশরুমের ওপর, এবং তারা কুঁকড়ে যায়। খুব ভোরে যখন শঙ্খচিল চক্কর দেয় তার নিজস্ব পথে, নিচে তার বিস্তীর্ণ জলরাশি, পৃথিবীটা জলের ভেতরে একটা বহুরঙা পাথরের মতো ঘুমিয়ে থাকে, তখন তিনি কেবলই তাঁর কেন্দ্রের দিকে ডুবে যেতে থাকেন। আর এদিকে সারাদিন একটা খোলা নৌকায় খাঁড়ির ওপর ঘুরে ঘুরে শেষমেশ আমরা একটা নীল লণ্ঠনের ভেতর ঘুমিয়ে পড়ি, যখন শূন্যতা আমাদের দিকে তার মুখটি ফিরিয়ে ফিসফিস করে বলে: “আমি শূন্য নই, আমি উন্মুক্ত।”

নির্জনতা আর নৈঃশব্দ্যের দেবদূত এই স্ক্যান্ডিনেভিয়ান কবির কবিতা ইতোমধ্যে ৬০-টিরও অধিক ভাষায় অনূদিত হয়েছে।

ট্রান্সট্রোমারের বাংলা অনুবাদের ক্ষেত্রে আমি মূলত May Swenson, Robert Bly, Robin Fulton এবং কয়েকটি কবিতার ক্ষেত্রে Göran Malmqvist, Robin Robertson, Patty Crane-এর ইংরেজি অনুবাদের সাহায্য নিয়েছি। অনেক বাক্য এবং শব্দের বিভ্রান্তি কাটাতে তাঁর মূল গ্রন্থ Dikter och prosa (1954-2004) ব্যবহারেরও চেষ্টা করেছি। ─নান্নু মাহবুব

 

মলোকাই

আমরা গিরিচূড়ার কিনারায় দাঁড়িয়েছিলাম আর আমাদের বহু নিচে
কুষ্ঠ কলোনির ছাদগুলো চকচক করছিল।
আমরা হয়তো এখান থেকে নামতে পারব কিন্তু রাত্রি নামার আগে আগে
আবার কিছুতেই উঠে আসতে পারব না।
তাই আমরা আবার অরণ্যের দিকেই ফিরি, দীর্ঘ নীল-নীল সুচযুক্ত
গাছগুলোর ভেতর দিয়ে হাঁটতে থাকি।
এখানে খুব নৈঃশব্দ্য, বাজপাখির আগমনের মতোই নৈঃশব্দ্য।
এই সেই জঙ্গল যেটা সবকিছু ক্ষমা করে দেয় কিন্তু ভোলে না কিছুই।
ভালবাসার জন্যে ড্যামিয়েন বেছে নিয়েছিলেন জীবন আর বিস্মরণ।
পেয়েছিলেন মৃত্যু এবং খ্যাতি।
কিন্তু আমরা এইসব ঘটনা উলটোভাবে দেখি: স্ফিংক্সের মুখের বদলে
দেখি পাথরের স্তূপ।

মলোকাই: Molokai; হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের অন্যতম একটি দ্বীপ। সর্বাধিক পরিচিত তার কুষ্ঠ কলোনির জন্য। একশো বছর আগে এখানে ড্যামিয়েন (Saint Damien of Molokai) কর্মরত ছিলেন এবং এখানেই  তাঁর মৃত্যু হয়।

[Robin Fulton অনূদিত Molokai থেকে।]

 

ক্যাপ্রিচোস

ওয়েলবা অন্ধকার হয়ে আসছে: ঝুলে-ভরা সব খেজুর গাছ
আর রুপোশাদা বাদুড়ের মতো
দ্রুতগামী ট্রেনের হুইসেল।

রাস্তাগুলো সব লোকে ঠাসা।
আর ভিড়ের মধ্যিকার ব্যস্তসমস্ত মহিলাটি তার চোখের মাপকাঠিতে
সতর্কভাবে পড়ন্ত বেলার আলোটা পরিমাপ করছিল।

অফিসের জানালাগুলো খোলা। সেখান থেকে
এখনও অশ্বক্ষুরের শব্দ শোনা যাচ্ছে।
বুড়ো ঘোড়াদের খুরে রাবার স্ট্যাম্প লাগানো।

মধ্যরাত্রির আগে রাস্তাগুলো ফাঁকা হবে না।
শেষমেশ অফিসগুলো সব নীলে ভরে যাবে।

উপরে ওই মহাশূন্যে:
নিঃশব্দে কদম ফেলছিল, ঘোর জ্বলজ্বলে,
অজ্ঞাত এবং বল্গাহীন,
সওয়ারি-ছুড়ে-ফেলা:
নতুন একটি তারকাপুঞ্জ, আমি যার নাম দিয়েছি “অশ্ব”।

………….

ক্যাপ্রিচোস: (spanish) caprichos;  (eng.) caprice; খামখেয়ালিপনা; স্প্যানিশ শিল্পী  ফ্রান্সিসকো গয়ার একটি এচিং সিরিজের শিরোনামও ক্যাপ্রিচোস। ওয়েলবা: Huelva; দক্ষিণপশ্চিম স্পেনের একটি বন্দরনগরী।

[May Swenson অনূদিত  Caprichos থেকে।]

 

একাকিত্ব


ফেব্রুয়ারির এক রাতে আমি এখানে প্রায় মরতেই বসেছিলাম।
গাড়িটা পিচ্ছিল ঢাল বেয়ে একপাশে পিছলে গেল আর রাস্তার
রংসাইডে গিয়ে পড়ল। এগিয়ে আসতে থাকা গাড়িগুলো─তাদের
বাতিগুলো─ঘন হয়ে আসছিল।

আমার নাম, আমার মেয়েরা, আমার পেশা, সব ছিটকে গিয়ে নিঃশব্দে
পেছনে পড়ে রইল, দূরে, বহুদূরে চলে গেল। আমি যেন একটা
স্কুুলচত্বরে শত্রুপরিবেষ্টিত কোনো বালকের মতো একজন অজ্ঞাতনামা।

এগিয়ে আসতে থাকা গাড়িগুলোর আলো ছিল খুব তীব্র।
সেই আলো আমার ওপর হামলে পড়ল যখন ডিমের শ্বেতাংশের
মতো ভাসমান স্বচ্ছ একটা আতঙ্কের মধ্যে আমি প্রাণপণে স্টিয়ারিং
ঘুরিয়ে যাচ্ছি। মুহূর্তগুলো সব বড় বড় হয়ে গেল─সেগুলোর মধ্যে
জায়গা তৈরি হয়ে গেল─সেগুলো হসপিটাল বিল্ডিঙের মতো
বড় বড় হয়ে গেল।

মনে হলো যেন ধ্বংস হয়ে যাবার আগে
আমি ধীরেসুস্তে খানিকটা
শ্বাসও নিয়ে নিতে পারি।

তারপর একটা দূর্গের উদয় হলো: সাহায্যকারী একটা বালুদানা,
বা বিস্ময়কর একটা দমকা হাওয়া। গাড়িটা আলগা হয়ে তীব্রবেগে
রাস্তা দিয়ে গড়িয়ে গেল। একটা পোল উপড়ে গিয়ে ফেটে গেল─
তীক্ষ্ণ একটা ধাতব শব্দ হলো─আর শব্দটা অন্ধকারের ভেতর উড়ে গেল।

তারপর সব শান্ত হয়ে এলো। আমি আমার সিটবেল্টের মধ্যে স্থির
হয়ে বসে রইলাম আর দেখলাম কীভাবে একজন তুষারঝড়ের ভেতর
আমার অবস্থাটা দেখার জন্যে এগিয়ে এলো।


বহুক্ষণ ধরে আমি
হিমজমাট সুইডিশ মাঠে মাঠে ঘুরছি।
কোথাও কোনো জনমনিষ্যি চোখে পড়ে নাই।

পৃথিবীর অন্য প্রান্তে রয়েছে সেইসব মানুষেরা,
যারা এক অবিরল ভিড়ের ভেতর জন্ম নিচ্ছে, দিনযাপন
করছে, মৃত্যুবরণ করছে।

সর্বক্ষণ দৃশ্যমান থাকতে হলে─
এক ঝাঁক চোখের ভেতর জীবনযাপন করতে হলে─
অবশ্যই একটা বিশেষ অভিব্যক্তি গড়ে উঠবে।
মৃত্তিকালিপ্ত একটা মুখাবয়ব।

অশান্তির রাজ্যটা ওঠানামা করে
যখন তারা নিজেদের ভেতর আকাশ, ছায়া আর
বালুদানা ভাগাভাগি করে।

সকালে দশ মিনিট এবং সন্ধ্যায় দশ মিনিট আমাকে
অবশ্যই একা হতে হবে।
─কোনোরকম কর্মসূচি ছাড়াই।

সবাই সবার দরজায় লাইন দিয়ে আছে।

বহুজন।

একজন।

…………
[Robert Bly অনূদিত Solitude থেকে।]

 

নীল বাড়ি

রৌদ্রোজ্জ্বল একটা রাত্রি। ঘন অরণ্যের মধ্যে দাঁড়িয়ে আমি আমার কুয়াশাচ্ছন্ন
নীল দেয়ালঅলা বাড়িটার দিকে তাকাই। যেন আমি সম্প্রতি মারা গেছি, এবং
বাড়িটাকে একটা নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছি।

আশিটিরও বেশি গ্রীষ্মকাল ধরে এটি দাঁড়িয়ে রয়েছে। এর কড়ি-বরগাগুলো
চারবার আনন্দ আর তিনবার বেদনায় নিষিক্ত হয়েছে। এই বাড়িতে বসবাসকারী
কারো মৃত্যু হলে বাড়িটা আবার রঙ করা হতো। মৃত ব্যক্তিটা নিজেই এটা রঙ
করতো, কোনো ব্রাশ ছাড়াই, ভেতর থেকে।

বাড়িটার ওপারে বিস্তীর্ণ একটা অঙ্গন। আগে সেখানে একটা বাগান ছিল, এখন
জঙ্গল। আগাছার স্থির সব ঢেউ, আগাছার প্যাগোডা, উৎসারিত লিখন, আগাছার
উপনিষদ, আগাছার একটা ভাইকিং নৌবহর, ড্রাগনের মাথা, বল্লম, একটা
আগাছা সাম্রাজ্য!

বুনো বাগানটির উপর বারবার ছুড়ে দেওয়া একটা বুমেরাঙের ছায়া ডানা
ঝাপটায়। আমার সময়ের বহু আগে যে লোকটা এই বাড়িতে বসবাস করতো তার
সঙ্গে এটার একটা সম্পর্ক রয়েছে। সেটা প্রায় একটা শিশুই। তার ভেতর থেকে
একটা তাগিদ নির্গত হতো, একটা চিন্তা, তীব্র একটা চিন্তা: “বানাও…আঁকো…”
তার নিয়তি থেকে মুক্ত হবার জন্যে।

বাড়িটা শিশুদের আঁকা একটা ছবির মতো। একটা অতিরিক্ত শিশুসুলভতা,
যেটা খুব বেড়ে উঠেছিল কারণ কেউ একজন খুব তাড়াতাড়ি তার শিশু হবার
দায় থেকে ইস্তফা দিয়েছিল। দরজাটা খোলো, ভেতরে ঢোকো! সেখানে ছাদের
ভেতরে অস্থিরতা এবং দেয়ালগুলোর ভেতরে প্রশান্তি। শয্যার উপর ঝুলছে আনাড়ি
একটা পেইন্টিং, সেখানে একটা সতেরো পালের জাহাজের ছবি, উত্তাল সাগর,
আর একটি হাওয়া, স্বর্ণালি ফ্রেম যাকে ধরে রাখতে পারে না।

এখানে সবকিছুতেই খুব তাড়াহুড়া, বাঁকবদলের আগে, চূড়ান্ত বাছাইয়ের
আগে। এই জীবনের জন্যে তোমাকে ধন্যবাদ! তারপরও আমি বিকল্পগুলোর
কথা ভাবি। স্কেচগুলি সবই সত্য হয়ে উঠতে চায়।

বহুদূরে জলের ওপর একটা ইঞ্জিন গ্রীষ্মরাত্রির দিগন্তটাকে প্রসারিত করে দিচ্ছে।
আনন্দ এবং বেদনা, দুটোই শিশিরের আতশী কাচে স্ফীত হয়ে উঠছে। আমরা
ঠিক জানি না, কিন্তু আমরা টের পাই: আমাদের জীবনের একটা সিস্টার শিপ
রয়েছে, যেটা সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি পথ পরিক্রমা করে চলেছে। যখন সূর্যটা জ্বলছে
দ্বীপগুলোর পিছনে।

…………
ভাইকিং: viking; স্ক্যান্ডিনেভিয়ার (৮ম থেকে ১১শ শতক) সমুদ্রচারী ব্যবসায়ী, যোদ্ধা ও জলদস্যুদের একটি দল।
সিস্টার শিপ:  sister ship; একই ধরনের, বা একই গঠনের আরেকটি জাহাজ।

[Robin Fulton অনূদিত The Blue House থেকে।]

 

নাম

গাড়ি চালাতে চালাতে আমার ঘুম পেল এবং আমি রাস্তার পাশে গাছের নিচে গাড়িটা
দাঁড় করালাম। তারপর ব্যাকসিটে গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে পড়লাম। কতক্ষণ? কয়েক
ঘণ্টা। অন্ধকার নেমে আসছিল।

হঠাৎ আমি জেগে উঠলাম এবং নিজেকে চিনতে পারলাম না। জেগে উঠেছি, কিন্তু
তাতে কোনো কাজ হচ্ছে না। কোথায় আমি? কে আমি? আমি এমন একটা কিছু যেটা
কিনা এইমাত্র একটা ব্যাকসিটে জেগে উঠেছে, বস্তাবন্দী একটা বেড়ালের মতো আতঙ্কে
ছটফট করছে। কে?

শেষমেশ আমার জীবনটা ফিরে আসতে লাগল। একটা দেবদূতের মতো আমার নামটা
ফিরে এলো। দেয়ালগুলোর বাইরে একটা ভেরী বেজে উঠল (লিওনরা ওভারচারে যেমনটি
বেজে থাকে) এবং উদ্ধারকারী পদক্ষেপগুলো দ্রুত সুদীর্ঘ সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো। এটাই
আমি! এটাই আমি!

কিন্তু বিস্মৃতির নরকে সেই পনেরো সেকেন্ডের লড়াইটা ভুলে যাওয়া অসম্ভব, হাইওয়ে
থেকে সামান্য কয়েক মিটার দূরে, যে হাইওয়ে দিয়ে আলো জ্বালা গাড়িগুলো সবেগে
পিছলে যাচ্ছে।

………….
লিওনরা ওভারচার: Leonora Overture; বিটোফেনের একমাত্র অপেরা।

[Robert Bly অনূদিত The Name থেকে।]

 

মে’র শেষে

প্রস্ফুটিত আপেল আর চেরিগাছগুলো শহরটাকে মিষ্টি মলিন
মে-র রাত্রির ভেতর ভাসতে সাহায্য করছিল, শাদা শাদা লাইফজ্যাকেট,
চিন্তাগুলো চলে যায় বহু দূরে।
ঘাস এবং আগাছাদের নীরব একগুঁয়ে ডানা-ঝাপটানি।
মেলবক্সটা স্থিরভাবে জ্বলছিল; যা লেখা হয়ে গেছে তা আর ফিরিয়ে নেওয়া
যাবে না।

মৃদু একটা শীতল বাতাস শার্টের ভেতরে ঢুকে হৃদয় হাতড়ায়।
আপেল আর চেরিগাছগুলো সলোমনের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হাসে।
তারা আমার টানেলের ভেতর প্রস্ফুটিত হয়। তাদেরকে আমার দরকার
ভুলে যাবার জন্যে নয়, মনে রাখার জন্যে।

…………..
সলোমন: Solomon; বাদশাহ সোলায়মান।

[Robin Fulton অনূদিত Late May থেকে।]

 

ওকলাহোমা


ট্রেনটা দূর দক্ষিণে এসে থামল। নিউইয়র্কে তুষারপাত হচ্ছিল।
কিন্তু এখানে একটা ফুলহাতা শার্টেই সারা রাত কুলিয়ে যায়।
তবু কেউ বাইরে নেই। কারগুলো শুধু
উড়ন্ত সসারের মতো আলোর ঝলকানি তুলে ছুটে যাচ্ছিল।


“আমরাই সেই রণক্ষেত্র, যারা
নিজেদের বহু মৃত নিয়ে গর্বিত…”
আমি জেগে উঠতেই একটা কণ্ঠস্বর বলে উঠল।

কাউন্টারের ওপাশের লোকটা বলছিল:
“আমি কিন্তু এটা বিক্রির চেষ্টা করছি না,
আমি কিন্তু এটা বিক্রির চেষ্টা করছি না,
আমি শুধু এটা আপনাকে একটু দেখাতে চাই।”
এবং সে ইন্ডিয়ান কুঠারগুলো দেখাল।

ছেলেটা বলছিল:
“জানি আমার একটা কুসংস্কার আছে,
তাই আমি এটা আমার কাছে রাখতে চাই না, স্যার।
আপনি আমাদেরকে কী ভাবতেছেন?”


এই মোটেলটা অদ্ভুত একটা খোলস। ভাড়া-করা একটি
গাড়িসহ (দরজার বাইরের বিশাল একটা শ্বেত ভৃত্য)
প্রায় স্মৃতিহীন এবং পেশাহীন আমি
শেষমেশ আমার কেন্দ্রের দিকে ডুবে যেতে থাকি।

…………..
ইন্ডিয়ান কুঠার: আমেরিকান আদিবাসী কুঠার।

[Robin Fulton অনূদিত Oklahoma থেকে।]

 

গাছ এবং আকাশ

গাছটি বৃষ্টির ভেতর ছোটাছুটি করছিল,
ধূসর ঢলের ভেতর সেটা খুব দ্রুত আমাদের
পাশ দিয়ে চলে গেল। তার একটা তাড়া ছিল।
চেরিবনের একটা ব্ল্যাকবার্ডের মতো সে বৃষ্টি
থেকে জীবন সঞ্চয় করছিল।

বৃষ্টি থেমে গেলে গাছটিও থেমে গেল।
উজ্জ্বল রাত্রির ভেতর স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে সে স্রেফ
আমাদের মতোই মহাশূন্যে তুষারপাতের
জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল।

……………
[Robin Fulton অনূদিত The Tree and the Sky থেকে।]

 

বিলাপগাথা

তিনি তাঁর কলমটা নামিয়ে রাখলেন।
সেটা টেবিলের ওপর স্থির হয়ে রইল।
সেটা শূন্যতার ভেতরে স্থির হয়ে রইল।
তিনি তাঁর কলমটা নামিয়ে রাখলেন।

বহু কিছু আছে যা লেখা যায় না আবার লুকিয়েও রাখা যায় না!
বহুদূরে ঘটতে থাকা কোনো কিছুর জন্যে তিনি বিবশ হয়ে ছিলেন,
যদিও দুর্দান্ত ট্রাভেল ব্যাগটা একটা হৃৎপিণ্ডের মতো ধুকপুক করছিল।

বাইরে তখন গ্রীষ্মের শুরু।
গাছপালার ভেতর থেকে কারো শিস ভেসে আসছিল─ মানুষ না পাখির?
এবং প্রস্ফুটিত চেরিগাছগুলো বাড়ি ফেরা ট্রাকগুলোর মাথায় মৃদু চাপড় দিচ্ছিল।

সপ্তাহ চলে যায়।
ধীরে রাত্রি আসে।
জানালার শার্শির ওপর থিতু হয় মথ:
মহাবিশ্ব থেকে আসা ক্ষুদে ক্ষুদে বিবর্ণ টেলিগ্রাম।

…………….
[Robin Fulton অনূদিত Lament থেকে।]

 

লিসবন

আলফামা শহরতলিতে হলুদ হলুদ ট্রামকারগুলো পাহাড়ের ঢালে ঢালে
গান গাইছিল।
সেখানে ছিল দুটো জেলখানা। একটা তস্করদের জন্যে।
তারা জানালার গরাদের ভেতর থেকে হাত নাড়ছিল।
চিৎকার করে তাদের ফটো তুলতে বলছিল!

“আর এইটাতে,” খণ্ডিত একটা লোকের মতো ফিকফিক করে
হাসতে হাসতে কন্ডাকটর বলছিল,
“এইটাতে থাকে সব পলিটিশিয়ানরা।” কিন্তু আমি দেখলাম শুধু অট্টালিকা,
অট্টালিকা আর অট্টালিকা, আর বহু উপরের একটি জানালায় বাইনোকুলারে
চোখ লাগিয়ে এক লোক বাইরে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।

নীলের ভেতরে ঝুলছিল ধোয়া কাপড়চোপড়গুলো।
দেয়ালগুলো ছিল খুব উত্তপ্ত।
মাছিরা আণুবীক্ষণিক হরফ পাঠ করছিল।
ছয় বছর পর, লিসবনের এক নারীর কাছে আমি জানতে চেয়েছিলাম:
“এটা কি সত্যি ছিল, না আমি এটা স্বপ্ন দেখেছিলাম?”

……………

লিসবন: পর্তুগালের রাজধানী শহর। আলফামা: লিসবনের পাশের একটি পুরনো শহর। খণ্ডিত একটা লোক: split man; খণ্ডিত কেন? সম্ভবত কন্ডাকটরের হাসিটা ছিল Alice in Wonderland-এর Humpty Dumpty-র সেই হাসিটির মতো, আকর্ণবিস্ত‍ৃত যে হাসিটির কারণে Humpty Dumpty-র মুখটাকে তখন অ্যালিসের কাছে খণ্ডিত বলে মনে হয়েছিল।

[Robin fulton অনূদিত Lisbon থেকে।]

 

এপ্রিল এবং নৈঃশব্দ্য

বসন্ত পরিত্যক্ত পড়ে আছে।
মখমলকালো ডোবাটা আমার
পাশাপাশি হামাগুড়ি দেয়,
যেখানে কোনো প্রতিবিম্ব পড়ে না।

জ্বলে শুধু হলুদ ফুলগুলি।

কালো বাক্সের ভেতরকার বেহালার
মতো আমি আমার ছায়ার ভেতরে
বাহিত হই।

শুধু যে বিষয়টা আমি বলতে চাই
সেটা বন্ধক রাখা রুপোর মতো
নাগালের বাইরে জ্বলজ্বল করে।

……………..
[Robert Bly অনূদিত April and Silence থেকে।]

 

কীরিয়ে

মাঝে মাঝে আমার জীবন আঁধারের ভেতরে তার দৃষ্টি মেলে দেয়।
এমন একটা অনুভূতি যেন দলে দলে জনতা রাস্তাজুড়ে অন্ধের মতো
ঠেলাঠেলি করছে, উত্তেজিতভাবে, কোনো এক দৈবের দিকে,
যখন আমি অদৃশ্য হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছি।

যেমন একটা শিশু তার হৃৎপিণ্ডের ভারি দুপদাপ শুনতে শুনতে
আতঙ্কে ঘুমিয়ে পড়ে। দীর্ঘ, দীর্ঘ সময়ের জন্যে, যতক্ষণ পর্যন্ত না
সকাল তার আলো ফেলছে তালাগুলোর ওপর আর অন্ধকারের
দরজাগুলো খুলে যাচ্ছে।

…………….
কীরিয়ে: (গ্রিক) Kyrie; একটি খ্রিস্টীয় স্ত্রোত্রমালা যা “প্রভু, দয়া করো” (“Lord, have mercy”) শব্দ দিয়ে
শুরু বা এর সমন্বয়ে গঠিত।

[Robin Fulton অনূদিত Kyrie থেকে।]

 

আগুনের গ্রাফিতি

বেদনাবিধুর ওই মাসগুলোতে শুধু তোমার সাথে মিলিত হবার
সময়টাতেই আমার জীবনটা জ্বলজ্বল করে উঠত।
জোনাকি যেমন জ্বলে আর নেভে, জ্বলে আর নেভে,
─আর আমরা জলপাই বনের অন্ধকারের ভেতর তাদের
ওড়ার ঝলকানিটা অনুসরণ করি।

বেদনাবিধুর ওই মাসগুলোতে আমার আত্মা জড়োসড়ো আর
নিষ্প্রাণ হয়ে বসে থাকত
কিন্তু আমার শরীর তোমার শরীরের ভেতরে চলে যেত।
রাত্রির আকাশ গর্জন করছিল।
আমরা চুপিচুপি মহাবিশ্বকে দোহন করে বেঁচে ছিলাম।

…………..
[Robin Robertson অনূদিত Fire Graffiti থেকে।]

 

নান্নু মাহবুব

জন্ম: ১১ জুন, ১৯৬৪, যশোর। লেখালেখির শুরু ৮০’র দশকে।

প্রথম কাব্যগ্রন্থ: রাত্রিকালীন ডাকঘর (প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৫)
দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ: পুনরুত্থিত শহর (প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি, ২০০৫)
তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ: আজ কী ফুল ফুটিয়েছো, অরণ্য? (প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি, ২০১৩)

প্রতিভাস, কোলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর ইউ জী কৃষ্ণমূর্তির
সাক্ষাৎকারভিত্তিক ৪টি অনূদিত গ্রন্থ:মাইন্ড ইজ আ মিথ, নো ওয়ে আউট, থট ইজ
ইয়োর এনিমি, ও মিস্টিক অব এনলাইটেনমেন্ট।
Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top