চে গুয়েভারা এক রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আইকন: আবদুর রব

চে গুয়েভারার জীবন, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক সক্রিয়তা এবং মৃত্যু তাকে একজন সাংস্কৃতিক আইকনে পরিণত করেছে । কিউবান বিপ্লবের নায়ক, ১৯৬৭ সালে বলিভিয়ার সেনাবাহিনীর হাতে তার মৃত্যুবরণের আগ পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে কমিউনিজম ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য নিরলস কাজ করে গেছেন। চে-টুপি বা টি-শার্ট আজ সারা পৃথিবীতে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতিক হয়ে উঠেছে।

চে তাঁর এই কাল্ট ব্যক্তিত্বের আড়ালে একজন চিকিৎসক, দাবা খেলোয়াড়, পিতা ও কবি। তিনি রাগবি খেলতেও ভালোবাসতেন। তাঁর সম্পর্কে রয়েছে নানা চমকপ্রদ তথ্য। খাতাপ্ত্রে তাঁর নাম ছিল আর্নেস্তো রাফায়েল গুয়েভারা দেলা সেরনা। চে বলতে সম্বোধন সূচক ‘হে’ বা ‘হেই’ বুঝায় । আবার বন্ধুও। কিউবায় রাজনৈতিকভাবে নির্বাসিত আন্তোনিও “নিকো” লোপেজ তাকে মজা করে চে ডাকতেন। পরিপারের লোকেরা ও বন্ধুবান্ধবেরাও তাঁকে এই নামে ডাকতেন। চে’র পূর্বপুরুষ প্যাট্রিক লিঞ্চ ১৭০০ খৃস্টাব্দে আয়াল্যান্ড থেকে আর্জেটিনায় অভিভাসন করেন। তাঁর বাবা বিদ্রোহী প্রকৃতির ছিলেন। চে বলতে গেলে তাঁর এই গুণটি পেয়েছিলেন।

গুয়াতেমালা সিটি ভ্রমণের সময় চে তাঁর প্রথম স্ত্রীর হিলদা গাদিয়া (Hilda Gadea Acosta) সাথে পরিচিত হন। হিলদা ছিলেন একজন পেরুভিয়ান অর্থনীতিবিদ যার রাজনৈতিক কানেকশন চে-কে প্রাক্তন সেনা কর্মকর্তা ও গুয়েতেমালার পেসিডেণ্ট জ্যাকোবো আরবেনজ গুজমান সরকারের সিনিয়র কর্মকর্তাদের সাথে পরিচিত হতে সাহায্য করে। সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি (সিআইএ) ১৯৫৪ সালে রাষ্ট্রপতি আরবেনজকে উৎখাত করার পরিকল্পনা করে যা চে গুয়েভারার উপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল। হিলদা তাঁর এক লেখায় বলেন যে, গুয়াতেমালাতে এসে তিনি বিশ্বাস করতে শুর করেন যে সশস্ত্র সংগ্রাম ছাড়া সাম্রাজ্যবাদ হটানো সম্ভব নয়।
তাঁদের পরিচয় শেষ পর্যন্ত গভীর প্রেমে গিয়ে গড়ায় । ১৯৫৫ সালে হিলদা যখন জানতে পারলেন তিনি গর্ভবতী তখন তিনি আর চে বিয়ে করেন করে নেন। ১৯৫৬ সালে তাদের কন্যা হিল্ডা বিয়েট্রিজ জন্ম নেয়। তিন বছরের মাথায় হিলদা গাদিয়ার সাথে তাঁর বিয়ে ভেঙে যায় যখন চে কিউবার বিপ্লবী আলেদা মার্চের প্রেমে পড়েন। হিলদা গাদিয়ার সাথে বিয়ে ভাঙ্গার এক মাসের মাথায় চে মার্চকে বিয়ে করেন এবং ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত তাঁরা একসাথে ছিলেন। এই সময় তাঁদের চার সন্তান আলেদা, ক্যামিলো, সেলিয়া এবং আর্নেস্টো জন্মায়।

চে সম্পর্কে কন্যা আলেদা মন্তব্য করেন, ” কী করে ভালোবাসতে হয়, আমার বাবা তা জানেন আর এটাই তাঁর সবচেয়ে সুন্দর বৈশিষ্ট্য— ভালোবাসার ক্ষমতা। একজন প্রকৃত বিপ্লবী হতে গেলে তাকে রোমান্টিক হতে হবে। আমার বাবার মধ্যে অন্যদের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা ছিল অপরিসীম। আমরা যদি শুধু তাঁর এই উদাহরণটাই অনুসরণ করতে পারতাম তবে পৃথিবীটা আরও সুন্দর হত”।

চে যখন মেডিকেলে পড়ছিলেন তখন তিনি দুবার দক্ষিণ আমেরিকা ভ্রমণে বের হন। ১৯৫০ সালে প্রথম তিনি যন্ত্রচালিত বাইসাইকেল নিয়ে একা বেরিয়ে পড়েন। উত্তর আর্জেটিনার গ্রামাঞ্চলে ২৮০০ মাইল ঘুরে বেড়িয়েছিলেন।

দ্বিতীয়বার ভ্রমণে বের হন ১৯৫২ সালে। একটা ভিনটেজ মোটরসাইকেলে, বন্ধু আলবার্তো গ্রানাডোর সাথে। তারা ৮০০০ মাইল পাড়ি দিয়েছিলেন। এই সময় সারা দক্ষিণ আমেরিকা জুড়ে যে দারিদ্র‍্য আর বৈষম্য তিনি প্রত্যক্ষ করেন তা তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিকে স্থায়ী ভাবে পালটে দেয়। তিনি বিপ্লবী হয়ে ওঠেন। দেখা গেল, ভ্রমণ মানুষকে শুধু জ্ঞানী আর অভিজ্ঞ করে না, কাউকে কাউকে বিপ্লবীও করে তোলে। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ চে-গুয়েভারা।

তাঁর এই দ্বিতীয় ভ্রমণের উপর ১৯৯৩ সালে দ্য মোটরসাইকেল ডায়েরিজ নামে একটা বই প্রকাশিত হয় যা নিউ ইয়র্ক টাইমসের বেস্টসেলার হয়ে ওঠে। সমালোচকরা বইটির ভূয়সী প্রশংসা করেন। পরবর্তীতে এই বইয়ের কাহিনী নিয়ে একটা চলচিত্রও নির্মাণ করা হয়।

কাস্ত্রোর বিপ্লবের পর, গুয়েভারা অর্থনীতির সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন পদে নিযুক্ত হন। এর মধ্যে ১৯৫৯ সালে ন্যাশনাল ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেন, যা তাঁকে  দেশের অর্থনীতিকে ভালোভাবে পরিচালনা করার ক্ষমতা দিয়েছিল। সুযোগটা কাজে লাগিয়ে তিনি আমেরিকায় চিনি রপ্তানির উপর নির্ভরতা কমাতে সচেষ্ট হন। পরিবর্তে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে বাণিজ্য বৃদ্ধির উপর গুরত্ব দেন। তিনি কিউবার নোটে ‘চে’ হিসাবে স্বাক্ষর করেছিলেন। অর্থ আর প্রচলিত অর্থ ব্যবস্থাকে তিনি অনেকটা ঘৃণা করতেন তাই এসব সিস্টেমগুলিকে চিহ্নিত করতে আগ্রহ দেখান। পরে তিনি শিল্পমন্ত্রীও নিযুক্ত হন।

শিক্ষার প্রতি তাঁর অনুরাগ গড়ে ওঠে পারিবারিকভাবে। গুয়েভারার বাড়িতে তাদের লাইব্রেরিতে ৩,০০০-এর বেশি বই ছিল যা চে-এর বুদ্ধিবৃত্তিক মনের জন্য প্রচুর উপাদান দেয়। হাঁপানির জন্য তিনি প্রায়শই শয্যাশায়ী হয়ে পড়তেন এবং সময় কাটাতে প্রচুর বই পড়তেন যা তাঁকে একজন গোগ্রাসী পাঠক বানিয়েছিল। তিনি সক্রিয় জীবনযাপনের জন্যও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। তিনি কার্ল মার্কস, উইলিয়াম ফকনার, জওহরলাল নেহেরু, এইচজি ওয়েলস, রবার্ট ফ্রস্ট এবং আরও অনেকের লেখা পড়েছিলেন। কিউবার শিক্ষা বিস্তারে কাস্ত্রো আর চে-গুয়েভারা অত্যন্ত গুরুত্ব দিতেন। ইউনেস্কোর মতে, ১৯৫৯ সালের আগে, কিউবার সাক্ষরতার হার প্রায় ৭৭% ছিল, যা ল্যাটিন আমেরিকায় চতুর্থ সর্বোচ্চ ছিল। পরিচ্ছন্ন ও সুসজ্জিত পরিবেশে শিক্ষা কার্যক্রম চালানোটাকে প্রাধন্য দিতেন।

১৯৬১ সালকে ‘শিক্ষা বছর’ ঘোষণা করা হলে, গুয়েভারা গ্রামাঞ্চলে স্কুল তৈরি করতে এবং শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য ‘সাক্ষরতা ব্রিগেড’ পাঠান। ফলে কাস্ত্রোর মেয়াদের শেষ নাগাদ, শিক্ষার হার বেড়েছিল ৯৬%, এবং ২০১০ সালের মধ্যে, ১৫ বছরের বেশি বয়সীদের জন্য কিউবার সাক্ষরতার হার ছিল ৯৯%।

সারা পৃথিবীতে তিনি বিল্পবের নায়ক হিসেবে সমাদৃত হলেও আমেরিকায় নির্বাসিত কিউবানরা বলবে যে চে একজন নির্মম কমিউনিস্ট বিপ্লবী ছিলেন। কিউবায় ১৮ শতকে নির্মিত কারাগার লা কাবানাকে তিনি একটি দুর্গে পরিণত করেন। এখানে জুন ১৯৫৯ পর্যন্ত “যুদ্ধাপরাধীদের” বিচারের জন্য “বিপ্লবী ট্রাইব্যুনালের” সভাপতিত্ব করেছেন। সেই সময় লা কাবানায় কয়েক হাজার প্রাক্তন সরকারী কর্মকর্তা, পুলিশ এবং সেনাবাহিনীর কর্মী যারা বাতিস্তা সেবা করেছিলেন তাদের গ্রেপ্তার ও বিচার করে কারাদণ্ড না হয় মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। এই বিচার কার্যক্রম গোটা লাতিন আমেরিকার পেশাদার সামরিক বাহিনীর ভিত নাড়িয়ে দেয়। কিউবার বিপ্লবীরা তখন এই অঞ্চলের পেশাদার সামরিক-সামাজিক এলিট শ্রেণীর জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বিপ্লবের সাফল্যের দ্বারা উত্সাহিত, চে বিদ্রোহ এবং বিপ্লবের বিষয়ে প্রকাশ্য বিবৃতি দিতে শুরু করেন। তিনি বলেন, “এই বিপ্লব শুধু কিউবান জাতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় কারণ এর প্রভাব গোটা ল্যাটিন আমেরিকার বিবেককে স্পর্শ করেছে। এই বিপ্লব লাতিন আমেরিকার অত্যাচারী শাসক ও জংনের শ্ত্রুদের সতর্ক করে দিয়েছে কারণ তারা সুশাসনের শত্রু। . . স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে এই বিজয় ক্ষণস্থায়ী নয় বরং ল্যাটিন আমেরিকা বিজয়ের প্রথম ধাপ।

কিউবা তখন গোপনে এই অঞ্চলে বিপ্লবী আন্দোলনকে সমর্থন করতে শুরু করেছে, প্রতিবেশী দেশগুলিকে অভ্যন্তরীণ হুমকির বিরুদ্ধে লড়াই করতে বাধ্য করেছে। অন্যদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিউবাকে চেপে ধরেছিল কারণ কাস্ত্রো আমেরিকান-মালিকানাধীন অর্থনৈতিক সম্পদকে জাতীয়করণ করতে যাচ্ছিলেন

অভ্যন্তরীণভাবে, কিউবায় স্থিতিশীলতা আনতে কাস্ত্রো লা কাবানায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা বন্ধ করলেন কারণ বিশ্ব তখন এই বিষয়টার উপর নজর রাখছিল। নতুন বিপ্লবী সরকারের প্রতি সমর্থন জোগাড় করতে এবং চিনির বাজার সন্ধানে চে-কে তিন মাসের জন্য বিশ্ব সফরে পাঠানো হয়েছ।

চে কখনো মিলিটারি স্কুলে যাননি বা সামরিক ব্যাজধারী না, অথচ জোসেফ স্টালিনের পর থেকে আন্তঃআমেরিকান সামরিক নীতিতে তিনি সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছেন। কিউবার বিপ্লবে তার ভূমিকা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তীব্র সমালোচনা এবং পশ্চিম গোলার্ধে সশস্ত্র কমিউনিস্ট বিদ্রোহের পক্ষে তার ভূমিকার জন্য ওয়াশিংটনের শীর্ষ গোয়েন্দারা তাকে বারবার হত্যাচেষ্টা করতে থাকে। ষাটের দশকে আমেরিকার কাছে তিনি ছিলেন ওসামা বিন লাদেন!

……

সূত্র:

https://medium.com/lessons-from-history/7-lesser-known-facts-about-youths favorite-revolutionary-che-guevara-1e2db4e8d2a6

https://www.historyhit.com/facts-about-che-guevara/

আবদুর রব

কবি, অনুবাদক, অনলাইন ম্যাগাজিন সম্পাদক ও অর্থনীতিবিদ। জন্ম ৩০ জুন ১৯৬১ সালে। পৈত্রিক নিবাস যশোর। বর্তমান বসবাস ঢাকায়। একটি আন্তর্জাতিক কন্সাল্ট্যান্সি ফার্মে কর্মরত। ৩৫টি দেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর।

শৈশব থেকে লেখালেখির শুরু। এ পর্যন্ত নয়টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত হয় যৌথ কাব্যগ্রন্থ ‘পূর্ণ প্রাণ যাবো’। অন্যান্য কাব্যগ্রন্থ: কে ঘুমায় কে জাগে (১৯৯৪); রূপান্তরের গান (২০০৩); আপেলসূত্র (২০১৪) ও বৃষ্টি থামার অপেক্ষায় (২০২০)। এছাড়া ছোটদের জন্য চীনা গল্পের তিনটি অনুবাদ গ্রন্থও আছে। এগুলো প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। বিদ্যাপ্রকাশ থেকে ২০১৭ সালে প্রকাশিত হয় অনুবাদ কবিতার বই ‘বৃষ্টির ভেতর এক গলিপথ’। বেশকিছু ভ্রমণকাহিনীও লিখেছেন তিনি। 

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top