আমিরুল আলম খানের অনুবাদ: দ্য আন্ডারগ্রাউন্ড রেলরোড

দ্য আন্ডারগ্রাউন্ড রেলরোড

সাউথ ক্যারোলাইনা

ওয়াশিটন এবং মেইন-এর সংযোগস্থল, যেখানে সারি সারি বাণিজ্যিক অফিস ও বিপণিবিতানগুলো শেষ হয়ে বিত্তশালীদের আবাসিক এলাকার শুরু, সেখানে মাত্র কয়েকটি বøকের পরই তক্তায় তৈরি এক বাড়িতে এন্ডারসন পরিবার বাস করেন। পোরচের পিছন দিকে মিঃ ও মিসেস এন্ডারসন সন্ধ্যাবেলাটা কাটান। মিঃ এন্ডারসন যখন তসরের তৈরি তামাকের থলি পরিস্কারে ব্যস্ত থাকেন, মিসেস এন্ডারসন তখন কাপড় সেলাই করেন। কাজের ফাঁকে আড়চোখে মিসেস এন্ডারসন পার্লার, খাবার ঘর, হেঁশেলের দিকে নজর রাখেন। আর তখন বেসি নিচে ছোট্ট শিশুদের সঙ্গে খেলাধুলা, তাদের জন্য খাবার রান্না করা, তাদের সাজানো-গোজানোর কাজ করে। দোতলায় ঠিক সিঁড়ির পাশেই শোবার ঘরে মেইজি ও বাচ্চা রেইমন্ড থাকে। পাশের ওয়াশরুমও তারা দু’জনে মিলে ব্যবহার করে। রেইমন্ড যখন দুপুরের ঘুমটা সেরে নেয়, বেসি তখন জানালার পাশে বসে স্বপ্নের জাল বোনে। সূর্যের আলোয় ঝলমলে গ্রিফিন বিল্ডিংএর উপরের দুটো ফ্লোরের কার্নিশে চোখ আটকে যায় তার।

মেইজির দুপুরের খাবার ব্রেড আর জ্যাম প্যাক করে সে ছেলেটাকে নিয়ে একটু ঘুরে এসেছে। তারপর রুপো আর গ্লাসের থালাবাসন, ঘটিবাটিগুলো সাফসুতরো করে রাখল। বিছানাপত্র গুছিয়ে বেসি ও রেইমন্ড স্কুল থেকে মেইজিকে নিয়ে একটা পার্কে যায়। বাঁশিওয়ালা সুন্দর সুরে বাঁশি বাজিয়ে তাদের মাতিয়ে দিল। এরপর কিছুক্ষণ তারা লুকোচুরি খেলে।

আজ শুক্রবার। তার মানে তাকে আজ বাজার সওদা করতে হবে। আকাশে ঘন মেঘের ঘনঘটা। বেসি গরুর গোশত, দুধ আর রাতের খাবার কিনে হিসেবের খাতায় একটা ইংরেজি এক্স অক্ষর লিখে সই করল।

মিসেস এন্ডারসন সন্ধ্যা ছ’টায় বাসায় ফিরলেন। ডাক্তার তাকে বাইরের খোলা আলো-হাওয়ায় আরও বেশি সময় কাটাতে পরামর্শ দিয়েছেন। দুপুরে খাওয়ার পর আশেপাশের অন্যান্য মহিলাদের সাথে নতুন হাসপাতালের জন্য চাঁদা তোলা তার দৈনন্দিন কাজের অংশ। হাসিখুশি প্রাণবন্ত মিসেস এন্ডারসন বাচ্চাদের বুকে জড়িয়ে আদর করে, চুমু দিয়ে বেরিয়ে পড়েন। রাতের খাবার পর আবার তাদের আদরসোহাগ করবেন। মেইজি কিৎকিৎ খেলায় মন দেয়। মিসেস এন্ডারসন বেসিকে ধন্যবাদ জানিয়ে শুতে গেলেন।

শহরের অপর প্রান্তের ডরমিটরিগুলো খুব দূরে নয়। সোজা রাস্তাও আছে। কিন্তু বেসি মেইন স্ট্রিটের প্রাণোচ্ছ¡ল সন্ধ্যা উপভোগের জন্য ঘুর পথেই সেখানে যায়। রাস্তায় সাদা-কালো মানুষের ভীড়। সার সার বাড়িগুলোর পাশ দিয়ে হেঁটে যাবার সময় সে দু’পাশের দোকানের বড় বড় কাঁচের জানালায় চোখ বুলায়। মেইন স্ট্রিটের একপাশে কাপড়ের দোকানে থরে থরে নানা রঙের নানা ধরনের পোশাক সাজানো; এম্পোরিয়ামগুলো ঝলমলে পণ্যে উপচে পড়ছে। অপর পাশের জেনারেল স্টোরগুলোও পাল্লা দিয়ে রকমারি পণ্যে ভরা। ডিসপ্লেতে রাখা এসব পণ্য তাকে অবাক করে। কিন্তু গ্রিফিন বিল্ডিংই সবচেয়ে আকর্ষণীয় মনে হয় তার।

সারা দেশে ১২-তলার এই ভবনটিই সর্বোচ্চ। ভবনটি দক্ষিণের গর্ব। নিচতলা জুড়ে বিভিন্ন ব্যাংকের অফিস। টেনেসি মার্বেল পাথরে নির্মিত ভলটেড সিলিং-এর বৈশিষ্ট্য। এখানে বেসির কোন কাজ না থাকলেও উপরের বিভিন্ন তলায় তার যাতায়াত আছে। গত সপ্তায় তার বাবার জন্মদিনে বাচ্চাদের নিয়ে সেখানে গিয়েছিল। চলন্ত সিঁড়ি বা এলিভেটর দিয়ে তারা আটতলায় ওঠে। শত শত মাইলের মধ্যে কোথাও এমন চলন্ত সিঁড়ি নেই। মেইজি আর রেইমন্ড এ সিঁড়ি দিয়ে অনেকবারই ওঠানামা করেছে। তাই তাদের দু’জনের কাছে এর তেমন আকর্ষণ আর নেই। কিন্তু বেসি যতবারই এ সিঁড়িতে ওঠে ততবারই বেশ অবাক হয়, সাথে একটু ভয়ও পায়। আর তাই দুর্ঘটনা এড়াতে সে সব সময় পাশের রেলিং ধরে ওঠানামা করে।

যে সব তলায় ইন্স্যুরেন্স এজেন্ট, সরকারি অফিস, রপ্তানি ফার্মের অফিস আছে সেগুলো ছাড়িয়ে তারা উপরে উঠে গেল। বলতে গেলে কোন অফিসেই কর্মখালি নেই। গ্রিফিন বিল্ডিং-এর ঠিকানা মানেই সে কোম্পানির আলাদা সুনাম, আলাদা মর্যাদা। ব্যবসার বাড়বাড়ন্ত। মিঃ এন্ডারসনের অফিসটাও বিভিন্ন নামি আইনবিদের অফিসগুলোর সাথেই। দামী কার্পেটে মোড়া অফিসগুলো ঘোর কালো দামী কাঠের দেয়াল আর চিত্তাকর্ষক কারুকার্যখোদিত দরজাগুলোয় বসানো ফ্রস্টেড গ্লাস। মিঃ এন্ডারসন এখানে তুলো ব্যবসায়ীদের পক্ষে চুক্তিতে কাজ করেন। সেখানে তার পরিবারের সদস্যদের দেখে তিনি তো অবাক। বাচ্চাদের কাছ থেকে খুব যত্নের সাথে তিনি ছোট কেকটা গ্রহণ করলেন। তবে এরপর নিজের কাজে ঠিক মন বসাতে পারবেন কি না, তা নিয়ে সন্দেহ জাগল। বেসির ভয় করতে লাগল এই ভেবে যে, কেউ হয়ত এবার তাকে এক হাত নেবেন। কিন্তু তেমন কিছুই ঘটল না। এন্ডারসনের সেক্রেটারি দরজা খুলে দাঁড়িয়ে রইলেন আর বেসি কনফেকশনারের দোকান থেকে বাচ্চাদের নিয়ে দ্রæত ঢুকে পড়ল।

সন্ধ্যায় বেসি ব্যাংকের চকচকে ব্রোঞ্জের দরজার পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরল। প্রতিদিনই বিশাল এ ভবনের চাকচিক্য তাকে বিমোহিত করে। একজন মুক্ত নারীর মতই সে পাশের রাস্তায় নেমে এলো। কেউ তার পিছু নেয় নি বা খারাপ কিছু বলেও নি। যদিও এন্ডারসনের পরিচিতদের মধ্যে কেউ কেউ জানে বেসি তার মেয়ে। এ নিয়ে তারা হাসাহাসিও করে।

সার সার সেলুনের আশেপাশে কুখ্যাত খদ্দেরদের ভিড় এড়াতে বেসি রাস্তা পার হয়ে ওপারে গিয়ে মাতালদের মধ্যে শ্যামকে খুঁজতে লাগল। কোণার দিকে খুব সাধারণ সব বাড়িতে গরিব শ্বেতাঙ্গদের বসবাস। এবার জোরসে পা চালাল বেসি। এ তল্লাটের বেশির ভাগই লোকই বড় বড় কারখানার ফোরম্যান অথবা মজদুর। মালিকরা কালোদের নিয়োগে আগ্রহী নয়। তাই এদের রোজকার জীবন সম্পর্কে বেসি তেমন কিছু জানে না।

সবে সে ডরমেটরিতে এসেছে। এখানে তার আসার মাত্র কয়েকদিন আগে লাল ইটের এই দোতলা বাড়িটার নির্মাণ কাজ শেষ হয়। হেজ আর চত্বরের চারাগুলো সবে লাগানো হয়েছে। ভবিষ্যতে চারদিকের গাছগুলো এক ছায়াঢাকা মনোরম পরিবেশ তৈরি করবে। খাঁটি ইট দিয়ে বানানো হয়েছে বাড়িটা। একটা ইটের গায়েও বৃষ্টির দাগ নেই। রঙটাও মন মাতানো। খুবই দৃষ্টিনন্দন ক্যাটারপিলার। ডাইনিং রুম, কমন স্পেস, বাংক রুম বা বসতঘরের ভেতরের উজ্জ্বল সাদা রং তখনও নতুনের মিষ্টি গন্ধ ছড়াচ্ছে। বেসির মতই অন্য কারো কেবল দরজার নব ছাড়া আর কোথাও হাত দিতে সাহস হয় না। না-জানি কোথায় কিসের একটা দাগ পড়ে যায়, সেই ভয়ে।

সাইডওয়াক ধরে যেতে যেতে বেসি অন্যদের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করে। তারা কাজ করে বাড়ি ফিরছে। কেউ কেউ মনিবের বাচ্চাদের খেলা দেখভাল করছে, যাতে মনিবরা সন্ধ্যাটা ভালভাবে উপভোগ করতে পারে। কেবল কালোদের অর্ধেক শনিবারে আধবেলা কাজ করে। তাই শুক্রবার রাতটা কাটে ব্যস্ততায়।

বেসি ১৮ নম্বরে এলো। মেয়েরা চুল আঁচড়ে উপরে যাবে ডিনার করতে যাবে। বেসির আসার আগে বাংক রুমের আশিটি সিটের মাত্র একটা খালি হয়। একদিন আগে এলে তাকে একটা জানালার নিচে ঘুমোতে হত। যাহোক, একটা মেয়ে একটা ভাল সিটে চলে যায় বলে রক্ষা। জানালা গলিয়ে শরীর জুড়ানো বাতাসে তার মন আনন্দে নেচে উঠল। একটু ঘুরে শুয়ে সে তারাভরা আকাশের রূপ উপভোগ করতে পারবে।

ট্রাংক খুলে বেসি তার নীল রঙের জামাটা বের করল। সাউথ ক্যারোলাইনায় আসার সপ্তাহ দুই পর জামাটা কেনা। দু’পায়ের উপর রেখে সে জামার ভাঁজ সোজা করে নেয়। জামার নরম পরশ তাকে শিহরিত করে। সে অনুভূতি বেসি কখনও ভুলতে পারে না। কাজ শেষে পোশাকগুলো সুন্দর করে ভাঁজ করে একটা থলেয় ভরে বিছানার নিচে রেখে দেয়। শনিবার বিকেলে পড়াশোনার পর সেগুলো কাঁচবে। রাতে ঘুমানোর আগে সে টুকটাক কাজগুলো সেরে রাখে যাতে সকালে তাকে আর সে সব নিয়ে ভাবতে না হয়। মার্গারেট একজন রাঁধুনী । সে ৮ নম্বরে থাকে। রাতে খাবার জন্য মুরগির রোস্ট, গাজর আর আলু দিয়ে সবজি রেঁধেছে আজ। আজ মুরগির রোস্টটায় লবণ একটু বেশি হলেও মাংস খুব ভাল সেদ্ধ আর নরম হয়েছে। প্রক্টর মনে করেন, এই ডরমেটরির বাসিন্দারা নিজ নিজ ঘর ছাড়াও পুরো ক্যাম্পাস পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখবে। সামান্য হলেও এটা একটা মহৎ আইডিয়া।

রুটিতে মাখন লাগাতে লাগাতে বেসি পরদিনের কাজের আলোচনা শুনছিল। কাল বাচ্চাদের সেলুনে নিতে হবে। পাশেই কালোদের জন্য একটা নতুন সেলুন খুলেছে। সেখানে নগদ শোধ না করে স্ক্রিপ দিলেও চলে। যদিও এর কোন দরকার নেই। বেসি থালাবাটিগুলো নিয়ে রান্নাঘরে রেখে সোজা উপর তলায় চলে গেল।

“বেসি?”

“শুভ সন্ধ্যা, মিজ লুসি।”

শুক্রবারে এতরাত পর্যন্ত লুসির থাকার কথা নয়। প্রক্টররা সন্ধ্যা ছ’টাতেই চলে গেছেন। অন্য ডরমেটরির মেয়েদের বল, আমি তাদের ভাল-মন্দ জানতে এসেছি। তার নিষ্ঠার প্রশংসা করে সবাই। তার পরামর্শে বেসি অনেক বেশি উপকৃত হয়। সব সময় তার পোশাক সুন্দর, ঝকঝকে। ধাতব চশমার আড়ালে তাকে খুব কঠিন মনে হলেও মুখের হাসিতে তার হৃদয়ের গভীর দরদ প্রকাশিত হয়।

“কেমন চলছে, হ্যাঁ?”

“ধরেন গে, কোয়াটারে যাচ্ছেলাম, মিজ লুসি।”

“ডরমিটরি, কোয়ার্টার না, কেমন?” লুসি শুধরে দেন।

“হুম, মিজ।”

“যাচ্ছেলাম না, যাচ্ছি। কেমন?”

“কেবল তো শিকচি…।”

“হুম, ভালই হচ্ছে।” বেসির পিঠ চাপড়ে মিস লুসি বললেন। “শোন, আগামি সোমবার তুমি কাজে বেরুবার আগে তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে, বুঝেছ?”

“কেন, গলতি কিচু, মিজ…?”

“না, না। কোন ভুল কর নি, বেসি। আমরা এমনি কিছু কথা বলব, হ্যাঁ?” এবার বাউ করে তিনি নিজের অফিসে চলে গেলেন।

কালো একটা মেয়েকে বাউ করা! (চলবে)

আমিরুল আলম খান 

জন্ম যশোর জেলার ভারতীয় সীমান্তলগ্ন শিববাস গ্রামে ১৩৫৮ বঙ্গাব্দের ১৫ই অগ্রহায়ণ।
পড়েছেন এবং পড়িয়েছেন ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য। এরপর মাধ্যমিক শিক্ষকদের প্রশিক্ষণে যুক্ত থেকেছেন। যশোর শিক্ষা বোর্ডে প্রথমে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক পরে চেয়ারম্যান ছিলেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি অপেশাদার সাংবাদিকতায় যুক্ত গত পাঁচ দশক ধরে। ইংরেজি দৈনিকে নিউ নেশান-এ প্রায় এক দশক সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করেন। দৈনিক ইত্তেফাক, প্রথম আলো, সমকাল, বণিক বার্তায় কলাম লেখেন।

গ্রামীণ পাঠাগার আন্দোলনে যুক্ত হয়ে বাংলাদেশে গ্রামোন্নয়নের নতুন মডেল ডিহি ইউনিয়ন পাবলিক লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেন। দেশের প্রাচীনতম এবং বৃহত্তম গণপাঠাগার যশোর পাবলিক লাইব্রেরির সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

শিক্ষা, ভাষা, প্রকৃতি, কৃষি, বাস্তুসংস্থানবিদ্যায় আগ্রহী। এসব নিয়েই তার বই: বাঙলার ফল, অরণ্যের পদাবলী, পারুলের সন্ধানে, কপোতাক্ষ-মধুমতীর তীর থেকে, বিপর্যস্ত ভৈরব অববাহিকা, পারুল বিতর্ক, বাংলাদেশের শিক্ষার স্বরূপ সন্ধান এবং বিদ্যাবাণিজ্যের রাজনৈতিক-অর্থনীতি।

তাঁর অনুবাদগ্রন্থ: আফ্রিকান-আমেরিকান উপন্যাস দি স্লেভ গার্ল। হ্যারিয়েট অ্যান জেকব রচিত এই আত্মজৈবনিক উপন্যাসটি বোস্টন থেকে প্রকাশিত হয় ইনসিডেন্টস ইন দ্য লাইফ অব এ স্লেভ গার্ল শিরোনামে, ১৮৬১ সালে।

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top