সৃজনী কচিকাঁচার মেলা
দৈনিক ইত্তেফাকের ভেতরের পাতায় ‘কচিকাঁচার আসর’ নামে শিশুকিশোরদের লেখা নিয়ে একটা পৃষ্ঠা প্রকাশিত হতো। ওই পাতায় নতুন সদস্যদের জন্য একটা নির্ধারিত ফরম ছাপানো হতো তখন। আমি একদিন ওই ফরমটা কাঁচি দিয়ে কেটে, ফিলআপ করে, খামে ভরে দৈনিক ইত্তেফাক কার্য্যালয়ের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিলাম। কয়েকদিন বাদে দেখলাম ‘কচিকাঁচার আসরের’ নতুন সদস্যের লিস্টিতে আমার নাম ছাপা হয়েছে।
ইত্তেফাকের ‘কচিকাঁচার আসরকে’ কেন্দ্র করেই ‘কচিকাঁচার মেলা’ গড়ে উঠতে শুরু করল। এই ‘কচিকাঁচার মেলা’ ছিল মূলত শিশুকিশোরদের সংগঠন। সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক বিষয়ক নানা কর্মকাণ্ড দিয়ে শিশুকিশোরদের পরিচালিত করাই ছিল এই সংগঠনগুলির মূল উদ্দেশ্য।
কলোনীর ইশকুলের হেডমাস্টার শামসুদ্দিন স্যার একদিন ‘কচিকাঁচার মেলার’ একটা শাখা খুললেন। স্যার এই শাখার নাম দিলেন ‘সৃজনী কচিকাঁচার মেলা’। আমি কলোনীর ইশকুলের ছাত্রী কোনোদিন ছিলাম না, কিন্তু তবুও তিনি আমাকে আর প্রদীপকে সংগঠনের সংগে যুক্ত করে নিলেন। আব্বা ছিল খুবই কড়া প্রকৃতির মানুষ— আব্বার জন্যই আমরা কোনো উলটাপালটা জায়গায় যাওয়ার সুযোগ পেতাম না। কিন্তু শামসু স্যার যখন এসে বললেন যে, পাপড়ি আর প্রদীপকে তাঁর সংগঠনে নিতে চান, আব্বা খুব একটা আপত্তি করল না। এর কারণ হতে পারে, শামসু-স্যার অত্যন্ত ভদ্র, উচ্চশিক্ষিত ও চুপচাপ ধরনের মানুষ ছিলেন। শামসু স্যারের ভাইবোনেরাও তখন মেডিক্যাল, বুয়েট, ইউনিভার্সিটিতে পড়াশুনায় রত ছিল। মোদ্দাকথা শামসু-স্যারের বাসার পরিবেশ হয়তো আব্বার পছন্দনীয় ছিল। শামসু-স্যারের কল্যাণে আমার আর প্রদীপের কপালে কিছু স্বাধীনতা জুটতে থাকল। যেমন আমরা দুই ভাইবোন তখন প্রতি বিকেলেই বাইরে যাওয়ার সুযোগ পেলাম। কিন্তু সেসব বিকেলগুলি আমরা খামাখাই দুষ্টুমি করে নষ্ট করার স্কোপ পেতাম না। ‘কচিকাঁচার মেলায়’ অবধারিতভাবে শরীরচর্চা করতেই হতো। শামসু-স্যারের মুখের বাঁশির হুইসেল বাজার সংগে সংগে আমাদের হাত-পা তুলে লেফটরাইট করতে হতো। ‘সৃজনী কচিকাঁচার মেলায়‘ খুব বেশি সংখ্যক সদস্য ছিল না। বিশ থেকে পঁচিশজন ছেলেমেয়েকে নিয়েই শামসু-স্যার কত কী যে করতে লাগলেন!
আমাদের নানারকম ড্রীল শেখালেন। এবং আমাকে অবাক করে দিয়ে ‘সৃজনী কচিকাঁচার মেলার’ লিডার করে দিলেন তিনি আমায়! ফলে একেবারে সকলের সামনে দাঁড়িয়ে আমার ড্রীল করানো শুরু হলো। আমি আনত নয়নে চুপচাপ স্যারের দিক নির্দেশনা মেনে চললাম।
স্যার মাঝেসাঝেই বিভিন্ন ফাংশানের আয়োজন করতে লাগলেন। আমার আর প্রদীপের স্টেজে গান-গাওয়া অবধারিত হয়ে উঠলো। যদিও আমরা ভাইবোন তখন কিছুই বাজাতে জানিনা। [প্রদীপ অবশ্য পরে ক্যাডেট কলেজে গিয়ে সব বাদ্যযন্ত্রই বাজাতে শিখেছিল। আর আমি ভুল-প্রণয়ে জীবন বলি দিচ্ছিলাম]!
ফাংশনের স্টেজে গাওয়ার আগে আমাদের নিয়মিত রিহার্সেলের ভেতর দিয়ে যেতে হতো। কোরাস বা সলো যা-ই গাই না কেন, স্যার নিজে হারমোনিয়াম বাজাতেন। স্যার না বাজালে অন্য কেউ বাজিয়ে দিতেন। কেউ না কেউ তবলা সংগত করত। যন্ত্র ছাড়া আমরা কোনোদিন গান করিনি।
তখনই আমরা বেশিরভাগ দেশাত্ববোধক গান শিখেছিলাম। রবীন্দ্র সংগীতও শিখেছিলাম। আর নজরুলগীতি আব্বা-চাচাজান খুব গাইত। আমি পরে অগ্রগামীতে পড়াকালীন আমাদের মিউজিক-টিচার নমিতাদির কাছে কিছু নজরুলগীতি শিখেছিলাম।
এর মাঝেই ইত্তেফাকের ‘কচিকাঁচার আসরে’ আমার লেখা চারলাইনের একটা ছড়া পাঠিয়ে দিলাম, কিন্তু তা ছাপা হলো না। রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই আমার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে বললেন—
আরেকটু ভালো করে লেখার চেষ্টা করতে হবে।
দিন কয়েক বাদে শামসু স্যার বিজয়দিবস উপলক্ষে একটা সাময়িকী বের করলেন, তাতে আমার ছড়া ছাপা হলো। সিলেটের সাপ্তাহিক ‘যুগভেরীতেও’ আমার একটা ছড়া ছাপা হলো। আমি এসব নিয়ে আম্মার হাড় জ্বালিয়ে ফেলতাম। মানে লেখা পাঠিয়ে দেবার পরের অস্থিরতা। আম্মা ছোটকার হাতে টাকা দিয়ে ‘যুগভেরী’ কিনে আনাতো। আর ইত্তেফাক আমাদের বাসায় প্রত্যহই রাখা হতো।
ছোটকা ‘রেডিও বেইজিংয়ের‘ নিয়মিত শ্রোতা হওয়ার সুবাদে আমাদের বাসায় চীনের ক্যালেণ্ডার, ডায়েরী, ভিউকার্ড সবই আসতো।
আর আমরা নিজেরাও খুব ভিউকার্ড কিনতাম। কিনে বন্ধুদের গিফট করতাম। বন্ধুরাও আমাদের গিফট করত।
‘ভিউকার্ডময়’ অসম্ভব সুন্দর এক জীবন ছিল আমাদের। ভিউকার্ড দেখে দেখেই আমার ব্যালে-ড্যান্সার হওয়ার সখ জেগেছিল! আমি চাইতাম চীন দেশের অপরূপ সুন্দরী মেয়েদের মতো ম্যাজেন্টা রঙের ড্রেস পরে পা-টা আকাশের দিকে তুলে ব্যালেরিনা হয়ে রাজহংসীর মতো করে ভেসে যেতে। [ আমার পা যাতে চীনদেশের মেয়েদের মতো ছোট্ট আর সুন্দর হয়, আব্বা সেজন্য আমাকে শিশুবেলা থেকেই টেডিজুতা (সামনের দিকটা সরু হয়ে চেপে থাকা, স্যু) পরাতে শুরু করেছিল]। বাসায় একা একা থাকলে আমি সে চেষ্টাও চালাতাম। কিন্তু নিজের ইষৎ ভারী পা আমি কিছুতেই খুব বেশি উপরে তুলতে পারতাম না। আর আমি যে ব্যালে-ড্যান্সার হতে চাই সেকথা ভুলেও কাউকে বলতাম না। আমার এই সখ ছিল ছেঁড়া কাথার নিচে শুয়ে থেকে লাখটাকার স্বপ্ন দেখার মতো। [টাকার অঙ্কটা ওই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে]
আমার কার্লি-হেয়ার তখন নাপিত ডেকে ছেলেদের মতো বয়কাট করে দেয়া হয়েছিল। আর আমিও আম্মার বানিয়ে দেয়া শার্টগুলি ধুমসে পরছিলাম। শার্ট আর ট্রাউজার পরে পিটি করতে যেতাম কলোনীর ইশকুলের মাঠে। পায়ে বাটা-কোম্পানীর শাদা-কেডস।
আমাদের বাসায় সান্ধ্য আইনের মতো একটা ব্যাপার ছিল। যেখানেই যাই, যতদূরে, যত কাজই থাকুক না কেন— মাগরিবের আজানের সাথে সাথে ডেরায় ফিরতে হবে।
সন্ধ্যা গড়িয়ে যাওয়ার পরে কোনোদিন বাসায় ফিরলে ভালোরকম উত্তম-মধ্যম জুটে যেত কপালে।
স্টেজে কোরাস গাইতে গেলে অন্তরা আমাকে একাই গাইতে হতো। কিন্তু আমার খুব ‘স্টেজ-ফ্রাইট’ ছিল [আজও তা বর্তমান]। ফলে আমার গলা কাঁপত। কিন্তু প্রদীপ বেশিরভাগ সময় সলোই গাইতো। কখনো কখনো কোরাসও গাইতো ও। ওই বয়সেই প্রদীপের গানের-গলা ছিল ভারি মিষ্টি! সুর আর তাল জ্ঞান ছিল একেবারে টনটনে।
‘সৃজনী কচিকাঁচার মেলায়’ একদিন কেন জানি মহাহুলুস্থুল কাণ্ড ঘটতে শুরু করল। শামসু স্যার আমাদের নিয়ে উঠেপড়ে লাগলেন। খুব ভালো করে শরীরচর্চা শেখাতে লাগলেন। আমরা অবাক হয়ে গেলাম স্যারের এমন উত্তেজনায়। স্যার নিজেই বললেন যে, কচিকাঁচার আসরের সম্পাদক রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই আর কবি সুফিয়া কামাল খালাম্মা ঢাকা থেকে সিলেটে আসছেন। উনারে রেলস্টেশনে নেমেই আসবেন আমাদের ডিসপ্লে দেখার জন্য। তাই আমাদের স্যার প্রস্তুত করাচ্ছেন। আমরাও খুশি মনে তালে তালে লেফট-রাইট চালিয়ে যেতে লাগলাম। সময় যত ঘনিয়ে আসতে লাগল আমাদের উৎসাহ ততই বেড়ে চলল। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য মহড়া চলল না, কারণ উনাদের টাইম নাই। উনারে শুধু আমাদের শরীরচর্চা দেখেই চলে যাবেন। ইতোমধ্যে আমাদের নানান অনুষ্ঠানের খবরাদি বার কয়েক ইত্তেফাকের ‘কচিকাঁচার আসরে’ ছাপা হয়েছে। সেসব খবরে আমাদের নামও ছাপা হয়েছে।
পূর্বনির্ধারিত দিন-তারিখে আমরা সকাল থেকেই রেলওয়ে-ইশকুল মাঠে জড়ো হয়ে গেলাম। বার কয়েক মহড়াও করলাম। শামসু স্যারের বাঁশির তালে তালে আমরা হাত মাথার উপর তুললাম, ফেললাম। ক্রমে ঠাঁ ঠাঁ রোদের ভেতর দাঁড়িয়ে আমরা অস্থির হয়ে উঠলাম। কিন্তু দাদাভাই আর খালাম্মার দেখা নাই। কখন আসবেন উনারা? এদিকে ভয়ে আমার বুক দুরুদুরু কাঁপছে। আমি লিডার হয়ে যদি সামান্য ভুল করি তাহলে পেছনের লাইনের সকলেই ভুল করবে। লিডার হলে ভুল করা গর্হিত অপরাধ।
তিন/চার ঘন্টা পার হয়ে গেল, কিন্তু দাদাভাই আর খালাম্মার দেখা নাই। হঠাৎ দেখি শামসু স্যার হন্তদন্ত হয়ে কোথা থেকে যেন এল। তাঁর সারা শরীরে ঘাম বেয়ে বেয়ে পড়ছে। আমাদের উদ্দেশে বললেন—
শোনো, আজ ট্রেন অনেক লেট হচ্ছে। উনারা ইশকুলে আসতে পারছেন না। তাই তোমাদেরই স্টেশনে যেতে হবে।
আমি পড়ে গেলাম মহা ফাঁপরে। স্টেশনে অত শত লোকের ভীড়ে আমি ড্রীল করব কীভাবে? কিন্তু আমাকে যেতেই হবে। লিডার ভেগে গেলে মেলার ড্রীল কে করবে?
শামসু স্যারের সংগে আমরা দলবেঁধে চললাম রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে। ট্রেন আসার আগেভাগে শামসু স্যার লোকজন সরিয়ে আমাদের লাইন করে দাঁড়ানোর ব্যবস্থা করে দিলেন।
ট্রেন থামলে নামলেন দাদাভাই আর খালাম্মা। দাদাভাইয়ের পরনে শার্ট-প্যান্ট। শার্টের উপরে হাতকাটা-সোয়েটার। খালাম্মার পরনে সরু-কালো-পাড়ে দুধ-শাদা জমিনের শাড়ি। শাড়ির উপরে কালো-শাল জড়ানো। শামসু স্যার উনাদের রিসিভ করে নামালেন। আমি মুখচোখ লাল করে দাঁড়িয়ে আছি। মাথার চুল ছোট বলে মাথায় স্কার্ফ বেঁধে নিয়েছি।
সবগুলি লাইনের সামনে আমি বিব্রতভাবে দাঁড়িয়ে আছি। আমাদের চারপাশে ট্রেনের যাত্রী আর কৌতূহলীদের ভীড়। শামসু স্যারের বাঁশি বেজে উঠতেই আমি দুই হাত দুইপাশে ছড়িয়ে ড্রীল করানোর জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলাম।
আধঘন্টা নাগাদ চলল আমাদের শরীর চর্চা। চারপাশে ততক্ষণে বহু মানুষের জমায়েত হয়ে গিয়েছে। কবি সুফিয়া কামাল কাছে এসে তাঁর শঙ্খের মতো শাদা শাদা আঙুল দিয়ে আমার থুতনি নেড়ে বললেন—
তোমরা সত্যিই কিন্তু খুব ভালো ডিসপ্লে করেছ…!
পাপড়ি রহমান
নব্বই দশকের অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য একজন কথাশিল্পী। এ পর্যন্ত গ্রন্থ সংখ্যা প্রায় পঁচিশটি। কথাসাহিত্যে কাজের পাশাপাশি তাঁর রয়েছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সম্পাদনাও। বাংলা একাডেমী থেকে গবেষণা গ্রন্থ ‘ ভাষা শহিদ আবুল বরকত’ প্রকাশিত হয় ২০১০ সালে। তাঁর ভিন্নধারার উপন্যাসগুলি প্রকাশ মাত্রই বোদ্ধা পাঠকের নজর কাড়তে সক্ষম হয়। তন্মধ্যে জামদানি তাঁতিদের নিয়ে উপন্যাস ‘বয়ন’ (২০০৮) প্রকাশিত হয় মাওলা ব্রাদার্স থেকে। পালাকারদের জীবন ভিত্তিক উপন্যাস ‘পালাটিয়া’ প্রকাশিত হয় ২০১১ সালে। আট বছর বিরতির পর বেঙ্গল পাবলিকেশন্স থেকে প্রকাশিত হয় ‘নদীধারা আবাসিক এলাকা’ (২০১৯)
২০২০ সালে উপন্যাস ‘পালাটিয়া’ রি-প্রিন্ট হয় কলকাতার বনেদী প্রকাশনা সংস্থা ‘অভিযান’ থেকে।
তিনি বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ সম্মাননা পেয়েছেন ২০১০ সালে। কলকাতার ‘ঐহিক মৈত্রী সম্মাননা’ পেয়েছেন ২০১৭ সালে। ২০২০ সালে পেয়েছেন বাংলা একাডেমী পরিচালিত ‘সাদ’ত আলী আখন্দ সাহিত্য পুরস্কার’।