পাপড়ি রহমানের স্মৃতিগদ্য: সুরমাসায়র

আমার বন্ধু পান্না 

পান্নার সঙ্গে ইশকুলের বাইরেও আমার পারিবারিক-হৃদ্ধতা গড়ে উঠেছিল। আমি আর আম্মা প্রায় বিকেলেই সুরমানদী নৌকায় পারাপার হয়ে রিকশা নিয়ে ক্বীনব্রিজের নিচ দিয়ে লালদিঘীর পারে চলে যেতাম। নিচতলায় ছিল পান্নাদের গোল্ডের দোকান— ‘কমলাভাণ্ডার’। দোকানের উপরে ছিল ওদের বাসা। পুরানো দিনের বাড়িগুলির মতোই অপ্রশস্ত একটা সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় যেতে হতো। সিঁড়িগুলি ছিল অত্যন্ত ঝকঝকে-পরিস্কার। নিত্য ধোয়ামোছার কল্যাণে হীম-সতেজ স্পর্শের মাঝেও সামান্য পিচ্ছিলভাব! সিমেন্ট আর বালির অস্তরণের উপর বয়সের বাটখারা আর ভেজা কাপড়ের কোমল-যত্ন সিঁড়িগুলিকে অমন চেহারা দিয়েছিল।

ওদের বাসায় গল্পগুজব করে চা-নাস্তা খেয়ে আম্মা আর আমি রাত আটটা-নয়টা নাগাদ বাসায় ফিরতাম। পান্নার মাকে আমি মাসীমাই ডাকতাম। পান্নার মা-কাকিমা দুজনেই ছিলেন অপরুপ-সুন্দরী। আমি যেন আজও তাঁদের দেখতে পাই। দুইজনেরই সুঠাম স্বাস্থ্য। ধবধবে ফর্সা গাত্রবর্ণ। ঘন ও কুচকুচে কালোচুলের মাঝখানে চওড়া করে সিঁদুর দেয়া। দেখে মনে হতো যেন কালো-বোঁটার মাঝখানে সদ্য শিমুলফুল ফুটে রয়েছে! এক-প্যাঁচ দিয়ে পরা শাড়িতে সদা হাস্যজ্জ্বোল দুই মাতৃ-প্রতিমা। মাসীমা কিছুটা স্বল্পবাক ছিলেন। কিন্তু কাকিমার মুখে ঝকঝকে দাঁতের নির্মল-হাসিটি সদা লেগেই থাকত। মাঝেসাঝে কাকাবাবু এসে আমাদের আড্ডায় শরিক হতেন। কাকাবাবু ছিলেন দারুণ আমুদে। কথায় কথায় সারা ঘর ফাটিয়ে দিয়ে হো হো করে হেসে উঠতেন।

পান্নাদের বাসার কোনো উৎসব-পার্বনই আমাকে বাদ দিয়ে হতো না। আমাকে সব উৎসবেই নিমন্ত্রণ করত ও। সেটা কারো অন্নপ্রাসন থেকে শুরু করে ঘরোয়া লক্ষ্মী পূজা— যা কিছুই হোক না কেন? কিন্তু আব্বার কড়াশাসনের বেড়াজাল ডিঙিয়ে সবকিছুতে আমার যাওয়া হতো না। মানে বাসার কারাগার থেকে আমি তেমন ছাড়া পেতাম না। আর রাতের সব প্রোগ্রামই আমার জন্য নিষিদ্ধ ছিল। একা একা কোথাও যাওয়া তো সম্ভবই ছিল না। আম্মাকে সাথে নিয়ে গেলেও রাতের কোনো অনুষ্ঠানেই আমার যাওয়ার অনুমোদন মিলত না। কোনো কোনোদিন এমনও হয়েছে আমি হয়তো পান্নাদের বাসায় যাওয়ার জন্য জেদ করেছি, ছোটকা আমাকে রিক্সায় করে পৌঁছে দিয়ে পরে এসে নিয়ে গিয়েছে। অবশ্য সিলেট শহরে তখন কোনো মেয়ের একা একা কোথাও যাওয়ার মতো পরিবেশ তৈরিই হয় নাই।

পান্নাদের বাসার সব অনুষ্ঠানাদিতে আমি যেতে না পারলেও পুজোর ভোগ আমার জন্য ঠিকই রাখা হতো। পান্না টিফিন বক্স ভরে আমার জন্য নারিকেলের নাড়ু-বরফি-পিঠা-সন্দেশ সবই ইশকুলে নিয়ে আসত। নলেন গুঁড়ে পাক দেওয়া নারিকেলের নাড়ুর স্বাদ আজ অব্দি আমার জিভে লেগে আছে।

পান্না ছিল বরাবর শান্ত স্বভাবের। আমি ততটাই অস্থির আর চঞ্চল। কিন্তু এই অপজিট স্বভাব আমাদের আণ্ডারস্ট্যাডিংয়ে কোনো মন্দ-ছাপ ফেলতে পারে নাই। পান্নার মনও ছিল অনেক উদার। ওর মাঝে মানবিক গুণাবলি অঢেল ছিল বলেই আমি ওকে অত্যন্ত পছন্দ করতাম। ভালোও বাসতাম।

ওদের দোকানে সোনার পাশাপাশি রূপার অলংকারও তৈরি হতো। ওদের দোকান থেকে আম্মা প্রায়ই অলংকার বানাত। আমিও আমার বাম হাতের অনামিকার জন্য ছোট্ট রুবি বসানো একটা আংটি বানিয়েছিলাম। এটা অবশ্য আমার ইশকুলের লাস্ট ক্লাসের ঘটনা। ওই ক্যাঁচরা বয়সে যার সাথে আমি প্রেমে [নাকি একাকীত্বতা কাটানোর মাধ্যম অথবা বাসার অতিরিক্ত শাসনে ডুবন্ত আমি খানিকটা দম নেবার জন্য হাতের কাছের যে কোনো জলজ, এমনকি শাপলার ডাঁটাকেও আকড়ে ধরে তাকে অবলম্বন ভেবেছি] মরীয়া ছিলাম, তার নাম ওই আংটিতে খোদাই করে দিয়েছিলাম। বলাই বাহুল্য আব্বা ও আম্মার পুঞ্জাক্ষীকে ফাঁকি দিয়ে। আমার ওই ছোট্ট রুবি বসানো আংটির ভেতরে আমি দুইটা নামের আদ্যক্ষর লিখে দিতে বলেছিলাম। রুবি পাথরটা বসানো ছিল আংটির ঠিক মাঝখানে। পাথরের ধার ঘেঁষে ভেতরের দিকে গায়ে গা লাগিয়ে আমি ‘PA’ লিখতে বলেছিলাম। এবং পান্নার দোকানের কর্মচারিরা আমার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে তা লিখে দিয়েছিল। বলাই বাহুল্য এই P মানে পাপড়ি। আর A তে অলোক। অলোককে অবশ্য আলোক নামেও ডাকত তার ঘরের লোকজন। কিন্তু তার আসল নাম ছিল ‘অলোক’। পান্নাদের দোকানে আমি বা আম্মা যে অলংকারই গড়িয়েছি কাকাবাবু কোনোদিন এক পয়সাও মেকিং-চার্জ দিতে দেন নাই। আম্মা জোরাজুরি করলেও উনি তা নিতেন না।

আমি এই PA আইডিয়াটা পেয়েছিলাম ক্যাপ্টেন মুজিবের কাছ থেকে। ছোটফুফুর চাচাতো দেবর মাখন তখন সিলেট ক্যান্টনমেন্টের মেজর ছিলেন। উনার সাথে জিপগাড়িতে করে এই ক্যাপ্টেন মুজিব আমাদের বাসায় প্রতি রোববারেই আসত। মাখনমামা না এলেও সে আসত। [ব্যাচেলর ছিল তাই হয়তো সময় কাটাতে আসত।]ওই মুজিবের হাতে একটা পার্ল বসানো স্বর্ণের আংটি ছিল। মুজিব আমাকে একদিন তার আঙুল থেকে আংটি খুলে দেখিয়েছিল ভেতরে লেখা RK. আমি জানতে চেয়েছিলাম এই দুই অক্ষরের মানে কী? মুজিব হাসতে হাসতে বলেছিল— রাজকুমারী। আমি আর বিশদ কিছু জানতে চাই নাই। মুজিবের অতিরিক্ত ছটফটে স্বভাবের জন্য তাকে আমার কখনই ভালোও লাগে নাই। মুজিব ছিল তিড়িংবিড়িং করে লাফিয়ে চলা একটা চড়ুইয়ের মতো। মুজিবের অস্থির স্বভাব ছাড়াও আমি চিরকালই আর্মি প্রফেশন অপছন্দ করেছি। কিন্তু আমার একমাত্র ভাই প্রদীপ ক্যাডেট কলেজ শেষ করে আর্মিতেই জয়েন করেছিল।

ক্যাপ্টেন মুজিবের নামটাও আমি চাইলেই তখন আমার আংটিতে লিখতে পারতাম। মুজিবকে শুধু একবার বললেই সে খুশিতে লাফ দিয়ে উঠত। আর সেটা হলে আংটির ভেতরের অন্ধকারে আমাকে লিখতে হতো PM. কিন্তু আমি তা চাইনি। যে কোনো পুরুষ দেখলেই তার পেছনে ছোঁকছোঁক করা অত ছোট বয়স থেকেই আমি এভয়েড করেছি। আমার ওসব হ্যাংলামি ভালো লাগত না। পরে অবশ্য ক্যাপ্টেন মুজিব আমার চাইতে বয়সে ঢের বড়, আমার দূর সম্পর্কের ডিভোর্সী চাচাতো বোনকে বিয়ে করেছিল। আংটির ভেতরে নামের আদ্যাক্ষর বসানোর প্রসংগ এল বলেই ক্যাপ্টেন মুজিবের কথা উল্লেখ করলাম। নইলে সে আমার স্মৃতিতে সামান্য দাগ কেটে রেখে যাওয়ার মত উজ্জ্বল কোনো চরিত্র নয়।

পান্না বরাবরই অলংকার শোভিত ছিল। এমনকী ও পায়ে মল ও আংটিও পরত। তখন পায়ে আংটি পরার চল খুব কম ছিল। পান্না একদিন আমাকে একটা পায়ে পরার জন্য রূপোর আংটি উপহার দিলো। আমিও তা খুশি মনে বাসায় নিয়ে এলাম। পায়ে আংটি পরলে আমার আবজাব লাগে বিধায় আমি সেই আংটি পরলাম আমার বাম হাতের রিঙফিংগারে। খুব সুন্দর ছোট্ট একটা রূপালী রঙের গোলাপফুল ফুটে থাকল আমার অনামিকায়। কিন্তু আব্বা আঙুলে আংটি দেখেই কৈফিয়ত তলব করল—

কই পাইছস এইটা? কে দিছে তোরে?

আমি যতই বলি পান্না দিয়েছে আব্বা মানতেই চায় না। বলল—

এভাবেই তুমি লোভি হয়ে উঠবে পরের দ্রব্য নিতে নিতে [ আহা! পিতৃশিক্ষা! সেই থেকে নির্লোভ! পরের কিচ্ছুতেই আমার লোভ নাই। এমনকী অন্য নারীদের পুরুষ নিয়েও কোনোদিন টানাহেচড়া করি নাই!]

এবং আব্বার প্রচণ্ড রাগের মুখে আমি পান্নাকে সে আংটি ফেরত দিয়ে দিলাম।

পান্না হতবিহ্বল হয়ে আমাকে বলল—

এইটা কী? আমি তো তোরে উপহার দিসি।

আমি গলায় উঠে আসা কান্না পেটে চালান করে দিতে দিতে বললাম—

আব্বা না করে দিসে, বলসে তোরে ফেরত দিতে।

না, এসবেও পান্নার সাথে আমার সম্পর্ক কোনোদিন ফিকে হয় নাই। ভালবাসা্র কমতি হয় নাই।

আমি আর পান্না বরাবর একই বেঞ্চে বসেছি। রেজাল্টের কারণে [আমাদের ইশকুলে রোল ১ বসতো এ সেকশনে, রোল ২ বসতো বি সেকশনে আর রোল ৩ বসতো সি সেকশনে, এভাবেই মেরিট অর্ডার অনুযায়ী সেকশন ভাগ করা হতো] একই সেকশনে রোল না হলেও প্রতিদিনই আমরা দেখা করেছি। কথা বলেছি। আমি ওর বাসায় গিয়েছি। পান্না এসেছে আমার বাসায়।

ক্লাস নাইনে উঠে আমি সাইন্স পড়লাম আর পান্না পড়লো আর্টস। সাইন্স-আর্টেস সীমানা আমাদের বন্ধুত্বের জন্য কোনো অন্তরায় হয় নাই। পান্নাকে আমি ডাকতাম ‘পান্নি’ বলে। ওর সুচারু চিবুকের কোমল মখমল ত্বক ছুঁয়ে ওকে আদর করতাম। ওর চিবুক ছিল আমার অত্যন্ত পছন্দের। আজও তাই রয়ে গিয়েছে। আমি ওকে এত ভালোবেসেছি কারণ— পান্না কোনো শঠতা শিখে নাই, ওপরচালাকিও না। আমার সাথে কোনোদিন মিথ্যা কথা বলে নাই ও। বা কোনোকিছু নিয়েই ভাব দেখায় নাই। ও চিরকাল আমার মংগল চেয়েছে। আমিও ওর মংগল চেয়েছি। আমার দেখা অনেক মানুষের মাঝ থেকেও আমি আজও ওকে আলাদা করতে পারি— কারণ ওর ভালোবাসায় কোনো কৃত্রিমতা নাই। ওর মনের পরিধি প্রায় দিগন্ত রেখাকে স্পর্শ করে থাকে।

আমি অনেক সময় রাগ করি—

কত চাকুরী করবি আর? ছুটি নে। চল দুইজনে মিলে বেড়াতে যাই।

পান্না হাসে আর মৃদুস্বরে বলে—

যাব রে, যাব। শীঘ্রই যাব।

পান্নার আর ছুটি হয় না।

একদিন সিলেটের এমসি কলেজে ওর ডিপার্টমেন্টে বেড়াতে গেলাম। ও তখন স্যোসিওলজির হেড অব দ্য ডিপার্টমেন্ট। ওর সেইরকম আলিশান অফিস। সেইরকম বসার চেয়ার।

পান্না এদিকসেদিক হাঁটতে লাগল। আমি ওর সামনের একটা চেয়ারে বসে আছি। কিন্তু ও বসছে না। খামাখাই পায়চারি করছে। অফিসের পিয়ন ফাইল নিয়ে এল। ও আমার দিকে তাকিয়ে সসংকোচে অনুমতি প্রার্থনা করে বলল—

আমি এখানে বসি?

আমি অবাক হলাম। আরে অইটা তো তোর চেয়ার। তোর সারাজীবনের অধ্যবসায় আর পরিশ্রমের অর্জন। তুই তাতে বসবি নাকি আমি বসব?

বন্ধুকে সম্মান জানাতে যে নিজের যোগ্যতাকেও পাশ কাটিয়ে যেতে চায়— পান্না হলো সেই মানুষ!

পান্না সংকোচ নিয়ে বসে ফাইলে সাইন করতে লাগল।

এই আমার বন্ধু পান্না, অকৃত্রিম বন্ধু পান্না! অত্যন্ত বিনয়ী ও নির্জন বন্ধু পান্না! যে অন্যকে সম্মান দিতে জানে। ফলে তার সম্মান তো বিধাতাই নিজ হাতে পাঠিয়েছেন এই পৃথিবীতে! তাকেই তো বিধাতা আলো দেন, যে অন্যদের মাঝে সে আলো বিলিয়ে যেতে পারে। (চলবে)

 

পাপড়ি রহমান

ব্বই দশকের অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য একজন কথাশিল্পী। এ পর্যন্ত গ্রন্থ সংখ্যা প্রায় পঁচিশটি। কথাসাহিত্যে কাজের পাশাপাশি তাঁর রয়েছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সম্পাদনাও। বাংলা একাডেমী থেকে গবেষণা গ্রন্থ ‘ ভাষা শহিদ আবুল বরকত’ প্রকাশিত হয় ২০১০ সালে। তাঁর ভিন্নধারার উপন্যাসগুলি প্রকাশ মাত্রই বোদ্ধা পাঠকের নজর কাড়তে সক্ষম হয়। তন্মধ্যে জামদানি তাঁতিদের নিয়ে উপন্যাস ‘বয়ন’ (২০০৮) প্রকাশিত হয় মাওলা ব্রাদার্স থেকে। পালাকারদের জীবন ভিত্তিক উপন্যাস ‘পালাটিয়া’ প্রকাশিত হয় ২০১১ সালে। আট বছর বিরতির পর বেঙ্গল পাবলিকেশন্স থেকে প্রকাশিত হয় ‘নদীধারা আবাসিক এলাকা’ (২০১৯)

২০২০ সালে উপন্যাস ‘পালাটিয়া’ রি-প্রিন্ট হয় কলকাতার বনেদী প্রকাশনা সংস্থা ‘অভিযান’ থেকে।

তিনি বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ সম্মাননা পেয়েছেন ২০১০ সালে। কলকাতার ‘ঐহিক মৈত্রী সম্মাননা’ পেয়েছেন ২০১৭ সালে। ২০২০ সালে পেয়েছেন বাংলা একাডেমী পরিচালিত ‘সাদ’ত আলী আখন্দ সাহিত্য পুরস্কার’।

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top