অদম্য মানবতার প্রতীক প্রমিথিউস

ইংরেজি ও বাংলাকবিতায়, গল্পে উপন্যাসে বহুবার বহু প্রসঙ্গে উচ্চারিত হয়েছে প্রমিথিউস নামটি। মহান গ্রিক নাট্যকার এসখাইলোসের কল্যাণেও প্রমিথিউসের নাম অনেকের কাছেই সুপরিচিত। প্রমিথিউসের উল্লেখ রয়েছে হোমার এবং হেসিওদের রচনাতেও। প্রমিথিউসের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় খৃস্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দিতে হেসিওদের থিওগেনিতে।গ্রিকপুরাণে প্রমিথিউস হলেন বিচক্ষণতা, ন্যায়পরায়ণতা এবং মানবতার প্রতীক।
তিনি মানুষকে দিয়েছিলেন জ্ঞান এবং শিখিয়েছিলেন আগুনের ব্যবহার। কোনো কোনো কাহিনিতে বলা হয়েছে তিনিই সৃষ্টি করেছিলেন মানুষকে। আর সারা জীবন ছিলেন মানুষের পরম বন্ধু।

ধরিত্রীমাতা গেইয়া ও পিতা আকাশরূপী ইউরেনাসের ছিল দানবাকৃতির অনেক সন্তান। এদের মধ্যে ছিল টাইটান। টাইটানরা ছিল মানবাকৃতির কিন্ত মানুষের চেয়ে আকারে অনেক বড় এবং অপরিমেয় শক্তির অধিকারী। টাইটান আইয়াপেটাসের ছেলে ছিলেন প্রমিথিউস। প্রমিথিউস তার বিচক্ষণতা ও দূরদর্শীতার জন্য দেবতা ও টাইটানসহ সকলেরই শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। প্রমিথিউস নামের অর্থই হচ্ছে পরিণামদর্শী। তার ভাইয়ের নাম ছিল এপিমিথিউস যার অর্থ অপরিণামদর্শী।
গ্রিকপুরাণে প্রমিথিউস শব্দটির মধ্যে প্রো মানে আগে আর মানথানো মানে বুদ্ধিমত্তা শব্দ দুটির সমন্বয় ঘটেছে। যিনি দূরদর্শী বা ভবিষ্যতদ্রষ্টা তিনি প্রমিথিউস। শব্দটি প্রোটো ইন্দো ইউরোপীয় শব্দ থেকে উদ্ভূত। ওই একই উৎস থেকে বৈদিক প্রমথ শব্দটির উৎপত্তি। প্রোমন্থন শব্দটিও একই সঙ্গে সম্পর্কিত। প্রোমন্থন বা মন্থনের মাধ্যমে আগুন জ্বালানো হতো। প্রমিথিউসের অন্য তিন ভাইয়ের নাম ছিল মেনেতিউস, অ্যাটলাস ও এপিমিথিউস।

স্বর্গের অধিকার নিয়ে দেবতাদের প্রধান জিউসের সঙ্গে তার পিতা ক্রনাসের যুদ্ধ হয়। সেই মহাযুদ্ধে ক্রনাসের পক্ষে ছিল টাইটানরা। কিন্তু টাইটান প্রমিথিউস জিউসের পক্ষে ছিলেন। প্রমিথিউস তার তীক্ষবুদ্ধি ও শক্তি দিয়ে সাহায্য করেন জিউসকে। সে কারণে জিউস তার প্রতি কৃতজ্ঞ ছিলেন।

স্বর্গের অধিকার পাওয়ার পর দেবতারা মানুষ সৃষ্টি করতে মনস্থ করলেন। কোনো কোনো কাহিনিতে আছে দেবতারা নিজেরাই মানুষ সৃষ্টি করেন। আবার কোনো কাহিনিতে আছে দেবতারা এই ভার দেন প্রমিথিউসের ওপর।

প্রথমে এই ভার দেওয়া হয় এপিমিথিউসকে। তিনি ছিলেন অপরিণামদর্শী ও অস্থিরচিত্তের। তিনি প্রথমে সৃষ্টি করেন জীবজন্তুদের। জীবজন্তুকে তিনি শক্তি সামর্থ সব দিয়ে ফেলেন। শিং, থাবা, পালক, ডানা, পশম এসবই পেয়ে যায় জীবজন্তুরা। মানুষের জন্য আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। তখন এপিমিথিউস অসুবিধায় পড়েন। কি করণীয় বুঝতে না পেরে তিনি ভাইয়ের সাহায্য চান।

প্রমিথিউস তখন মানুষ সৃষ্টির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি কাদামাটি থেকে মানুষকে সৃষ্টি করেন। অবশ্য কোনো কাহিনীতে রয়েছে দেবতারা প্রথমে সোনা, তারপর রূপা, তামা এবং সবশেষে লোহা দিয়ে মানুষ তৈরি করেন। প্রমিথিউস ভাবলেন মানুষকে পশুর চেয়ে শ্রেষ্ঠ করে গড়তে হবে। তাই তিনি দেবতাদের আকৃতিতে মানুষকে গড়লেন দুইপায়ে খাড়া দাঁড়ানো ভাবে। দিলেন বুদ্ধিমত্তা। আর পশুর সাথে লড়াই করার জন্য দিলেন অনন্য এক অস্ত্র: আগুন। এই আগুন তিনি নিয়ে আসেন স্বর্গ থেকে বা সূর্যের কাছ থেকে নলখাগড়ার মধ্যে লুকিয়ে। আগুনের বলে মানুষ পেল এক অনন্য সুরক্ষা আর শক্তি। তিনি মানুষকে আগুনের বিভিন্ন ব্যবহার শেখালেন।

অন্য এক কাহিনিতে আছে জিউস মানবজাতিকে ধ্বংস করে অন্য প্রজাতির জীব সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন। ভবিষ্যতদ্রষ্টা প্রমিথিউস জিউসের অভিসন্ধি বুঝতে পেরে মানুষের জন্য খুব দুঃখ বোধ করেন। মানুষকে সাবলম্বী করার জন্য তিনি দেবতা অ্যাপোলোর অগ্নিময় রথ থেকে আগুন চুরি করে নিয়ে আসেন। আগুনের ব্যবহার শেখানোর পাশাপাশি তিনি মানুষকে দেন বিজ্ঞান। শেখান গণিত ও লেখার কৌশল।

অন্য একটি কাহিনিতে রয়েছে দেবতারা মানুষকে বলেন পালিত পশুকে উৎসর্গ করতে। মানবদরদী প্রমিথিউস তখন এক কৌশল বের করেন। তিনি একটি ষাঁড়ের ভালো অংশের মাংসের টুকরোর ওপর নাড়িভুড়ি চাপা দিয়ে ঢেকে রাখেন। আর হাড়গোড়ের স্তূপ করে তার ওপর সাজিয়ে দেন চকচকে সাদা চর্বি। এইভাবে দুটি স্তূপ সাজিয়ে জিউসকে বলা হয় বেছে নিতে। জিউস সাদা চকচকে চর্বির স্তূপটি বেছে নেন। পরে অবশ্য জিউস নিজের ভুল বুঝতে পারেন যখন দেখেন চর্বির ভিতরে ষাঁড়ের হাড়গোড় ছাড়া আর কিছুই নেই। কিন্তু ততোক্ষণে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেছে। মানুষ দেবতাদের উদ্দেশ্যে পূজার বেদীতে চর্বি আর অস্থি উৎসর্গ করতো অর্থাৎ আগুনে পোড়াতো। মাংসের ভালো টুকরোগুলো নিজেরা রেখে দিত। জিউস তখন রেগে মানুষকে শাস্তি দিতে আগুনকে স্বর্গে নিয়ে যান। যাতে আগুনের অভাবে তারা ধ্বংস প্রাপ্ত হয়। প্রমিথিউস চুরি করে আগুন নিয়ে আসেন মানুষের জন্য।

মানুষকে শাস্তি দিতে জিউস তখন এপিমিথিউসের কাছে পাঠান মোহময়ী প্যান্ডোরাকে। তার সাথে দেন একটি বাক্স বা পাত্র। প্যান্ডোরার এই বাক্সের ভিতর থাকে রোগ, মহামারী, দুঃখ, অভাব যা মানবজাতিকে শাস্তি দেবে। প্রমিথিউসের নিষেধ সত্ত্বেও এপিমিথিউস প্যান্ডোরাকে গ্রহণকরে মানবজীবনে দুর্দশা ডেকে আনেন।

প্রমিথিউসের এই মানবপ্রেম তাকে জিউসের চক্ষুশূল করে তোলে। যুদ্ধের সময় তার সাহায্যের কথা ভুলে অকৃতজ্ঞ জিউস প্রমিথিউসকে এক নির্মম শাস্তি দেন। জিউসের আদেশে দেবরাজের দুই ভৃত্য ফোর্স এবং ভায়োলেন্স দেবকারিগর হেফাস্টাসের তৈরি কঠিন শিকল দিয়ে প্রমিথিউসকে বেঁধে রাখে ককেশাস পর্বতের কাজবেক চূড়ায়। সেখানে সারাদিন ধরে তার যকৃত ঠুকরে ঠুকরে খায় জিউসের ঈগল। প্রতি রাতে যকৃত আবার নতুন ভাবে গজায়। যাতে পরদিন ঈগল তা ঠুকরে খেতে পারে। অমর প্রমিথিউসের এই ভয়ংকর শাস্তি চলে অনন্তকাল ধরে। প্রমিথিউসের এই কাহিনি নিয়ে খৃস্টপূর্ব ৫ম শতাব্দিতে মহান গ্রিকনাট্যকার এসখাইলোস রচনা করেন তার ট্র্যাজেডি শৃংখলিত প্রমিথিউস।

প্রমিথিউসকে নিয়ে রচিত ট্রিলজির একটি পর্বে এসখাইলোস বর্ণনা করেন, শুধু মানুষকে আগুন এনে দেওয়ার জন্যই নয়, আরেকটি কারণে জিউসের ক্রোধের শিকার হন প্রমিথিউস। জিউস জানতে পারেন, নিয়তির নির্বন্ধ অনুসারে এক মানবকন্যার গর্ভে জিউসের এমন এক পুত্র জন্মাবে যে দেবতাদের স্বর্গ থেকে বিতাড়িত করে দেবরাজকে সিংহাসনচ্যূত করার ক্ষমতা রাখবে। একমাত্র প্রমিথিউসই জানতেন কে হবেন সেই পুত্রের মা।ধরিত্রী মা গেইয়ার কাছ থেকে প্রমিথিউস সেই তথ্য জেনেছিলেন।কিন্তু জিউসের শত নির্যাতনেও তিনি সেই গোপন তথ্য ফাঁস করতে রাজি হন না। প্রমিথিউস যখন ককেশাস পর্বতে শিকলবদ্ধ অবস্থায় অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করছেন সে সময় একাধিক বার জিউসের দূত দেবতা হার্মিস তাকে গোপন তথ্য প্রকাশ করার জন্য চাপ প্রয়োগ করেন। কিন্তু কোনো চাপের কাছে, ভয়ভীতি ও নির্যাতনেই নতি স্বীকার করেননি প্রমিথিউস।

বহু বছর পর গ্রিক বীর হারকিউলিস জিউসের ঈগলকে হত্যা করে প্রমিথিউসকে মুক্ত করেন।হারকিউলিস সোনার আপেল সংগ্রহের বিখ্যাত অভিযানে নেরেউসের পরামর্শ অনুসারে ককেশাস পর্বতে যান। সেখানে হেফেস্টাসের লৌহশিকল ভেঙে আর ঈগলকে হত্যা করে প্রমিথিউসকে মুক্ত করেন তিনি। প্রমিথিউসের পরামর্শেই অ্যাটলাসের কাছে যান হারকিউলিস আর সোনার আপেল সংগ্রহ করতে সক্ষম হন। হারকিউলিসই ছিলেন মানবকন্যার গর্ভজাত জিউসের সেই বীরপুত্র ও মানববংশধর যিনি জিউসকে সিংহাসনচ্যূত করার ক্ষমতা ধরেন।

গ্রিক পুরাণে প্রমিথিউস হলেন অন্ধ দৈব শক্তি ও অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করা নির্যাতিত মানবতার প্রতীক। প্রমিথিউস সেই জ্ঞানীদের প্রতীক যারা শত নিপীড়নেও পাশব শক্তির কাছে পরাজয় স্বীকার না করে মানবতার জয় ঘোষণা করেন।

 

শান্তা মারিয়া

২৪ এপ্রিল, ১৯৭০ ঢাকায় জন্ম।
ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলে পড়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগ থেকে অনার্স ও মাস্টার্স। বাংলা একাডেমির তরুণ লেখক প্রকল্পে ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহমা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতায় নারী নেতৃত্ব বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন।

১৯৯৭ সালে দৈনিক মুক্তকণ্ঠে সাংবাদিকতা শুরু। এরপর জনকণ্ঠ, আমাদের সময়, রেডিওআমার ও চীনআন্তর্জাতিক বেতার এবং বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরডটকম-এ সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছেন। সর্বশেষ আমাদের সময় পত্রিকায় ফিচার এডিটর পদে কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে চীনের ইউননান মিনজু বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার শিক্ষক। পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোটসহ মানবাধিকার বিষয়ক বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সেমিনারে পেপার উপস্থাপন করেছেন। কবিতা, গল্প ও ভ্রমণকাহিনি প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন পত্রিকায়। এ পর্যন্ত ৫টি কাব্যগ্রন্থসহ ১২টি বই প্রকাশিত হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র, নেদারল্যান্ডস, চীন, ভারত, শ্রীলংকা, নেপাল এবং বাংলাদেশের প্রায় সবক’টি জেলায় ভ্রমণ করেছেন। জ্ঞানতাপস ভাষাবিদ ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহর পৌত্রী ও ভাষাসৈনিক এবং বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মী মুহম্মদ তকিয়ূল্লাহর কন্যা। ভ্রমণ করতে ভালোবাসেন। মিথোলজি ও ইতিহাসপাঠ শান্তা মারিয়ার প্রিয় নেশা।

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top