একিলিস: প্রেমবঞ্চিত এক বীর

মানুষ জীবনে কী চায়? খ্যাতি ও কীর্তি নাকি দীর্ঘ শান্ত জীবন? কী চেয়েছিলেন একিলিস? হয়তো যুদ্ধ নয় বরং নারীর প্রেমই ছিল তার কাম্য। তবু সেটি পাননি তিনি। এক নিরুপদ্রব দীর্ঘ শান্ত জীবন অথবা যুদ্ধে অংশ নিয়ে বীরের মৃত্যু। একিলিসের জন্য বরাদ্দ ছিল এর যে কোনো একটি। মা তার জন্য প্রথমটি চাইলেও তার ভাগ্যে জুটেছিল দ্বিতীয়টি। তিনি ছিলেন ট্রয়যুদ্ধে গ্রিক পক্ষের শ্রেষ্ঠ বীর। হোমারের ইলিয়াডের কেন্দ্রীয় চরিত্র একিলিস।
মিরমিডনের রাজা পেলেউস ও সাগরপরী থেটিসের সন্তান ছিলেন তিনি। সাগরদেবতা নেরেউসের মেয়ে থেটিস প্রতিপালিত হয়েছিলেন হেরার কাছে। তিনি ছিলেন অপরূপ সুন্দরী। জিউস ও পোসাইডন দুজনেই তার সঙ্গে প্রেম করতে আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু প্রমিথিউস ভবিষ্যতবাণী করেন যে থেটিসের পুত্র খ্যাতিতে তার পিতাকে বহুগুণে ছাড়িয়ে যাবে। এই ভয়ে জিউস ও পোসাইডন আর সে দিকে পা বাড়াননি। কে না জানে যে, প্রেম, অর্থ ও খ্যাতির ক্ষেত্রে নিজ সন্তানের উৎকর্ষও অনেকে সহ্য করতে পারে না।
থেটিস ও পেলেউসের বিয়ের অনুষ্ঠান হয় খুব জাঁকজমক করে। সব দেবদেবী সেখানে আসেন। শুধু কলহদেবী এরিসকে নিমন্ত্রণ করা হয়নি। এর প্রতিশোধ নিতে তিনি ভোজ সভায় আড়াল থেকে ছুঁড়ে দেন ‘শ্রেষ্ঠ সুন্দরীর প্রাপ্য’লেখা সোনার আপেল যা ট্রয়যুদ্ধের সূচনা করে।

একিলিসের জন্মের পর থেটিস তাকে অমর করার জন্য স্টিক্স নদীতে বা অমরত্বের ঝরনায় ডুবিয়ে নেন। কিন্তু গোড়ালি ধরে তাকে ডুব দেওয়ানোর জন্য তার সারা শরীর অভেদ্য হলেও গোড়ালি বা টেনডন আঘাতসাধ্য থেকে যায়। এখন থেকেই একিলিস হিল বা একিলিস টেনডন প্রবাদবাক্যের উদ্ভব। মানুষের দুর্বলতম স্থান বোঝাতে এই বাগধারা ব্যবহার করা হয়।

একিলিসের শিক্ষাগুরু ছিলেন কিরন। একিলিসকে ডেমিগড বলা হয় কারণ তার মা ছিলেন অমর। কিন্তু একিলিস ডেমিগড হয়েও সাধারণ মানুষের মতোই রাগ, দুঃখ ও হতাশার শিকার হয়েছিলেন। তিনি বারে বারে অপমানের শিকার হয়েছেন বিভিন্ন সময়ে। ছোট বেলা থেকেই অহংকার আর ক্রোধ ছিল তার প্রচণ্ড।

তিনি হেলেনের পাণিপ্রার্থী ছিলেন। কিন্তু হেলেন তাকে বেছে নেননি। অন্যান্য পাণিপ্রার্থীদের সঙ্গে তিনিও প্রতিজ্ঞাও করেন যে হেলেনকে কেউ অপহরণ করলে তার উদ্ধারে অংশ নিবেন।

পরবর্তীতে যখন হেলেনের উদ্ধারের জন্য গ্রিক বাহিনি সংগঠিত হচ্ছে তখন তারও ডাক পড়ে। কারণ গ্রিসের শ্রেষ্ঠ বীর তখন ছিলেন একিলিস। থেটিস জানতেন ট্রয়যুদ্ধে অংশ নিলে ছেলের মৃত্যু হবে। তাই একিলিসকে নারীবেশ পরিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয় রাজা লাইকোমেডিসের প্রাসাদে। সেখানে প্রাসাদের মেয়েদের মধ্যে লুকিয়ে রাখা হয় তাকে। লাইকোমিডিসের কন্যা ডাইডামিয়ার গর্ভে তার পুত্র নিওপ্টলেমাসের জন্ম হয়েছিল।
অডিসিউস যান একিলিসকে খুঁজে বের করতে। তিনি ফেরিওয়ালা সেজে প্রাসাদের অন্দরমহলের প্রাঙ্গনে ঢোকেন। তিনি সাজগোজের জিনিসপত্রের সঙ্গে কয়েকটা অস্ত্রশস্ত্রও রাখেন। মেয়েরা যখন ফিতা, দুল ইত্যাদি দেখছে নারীবেশী একিলিস তখন অস্ত্রগুলো নেড়েচেড়ে দেখছিলেন। সেটা দেখেই অডিসিউস তাকে চিনতে পারেন।
ট্রয়যুদ্ধে যোগ দিতে বাধ্য হন একিলিস। শুরু থেকেই গ্রিক বাহিনীর সর্বধিনায়ক আগামেমননের সঙ্গে তার ব্যক্তিতের সংঘাত শুরু হয়। ট্রয়ের কাছাকাছি পৌঁছে একটি দ্বীপ দখল করেন তারা। যুদ্ধবন্দী মেয়েদের নিয়ে আসা হয় জাহাজে। বীরত্বের পুরস্কার হিসেবে একিলিস পান ব্রিসেইস নামে এক সুন্দরী মেয়েকে। তাকে বেশ ভালোবেসে ফেলেন একিলিস। এদিকে যুদ্ধবন্দীদের মধ্যে অ্যাপোলোর মন্দিরের পুরোহিতের মেয়ে ক্রাইসেইসও ছিল। তাকে পান আগামেমনন। মেয়েকে রক্ষার জন্য পুরোহিতের কাতর প্রার্থনায় অ্যাপোলো রেগে গিয়ে গ্রিকবাহিনীর মধ্যে মহামারী প্রেরণ করেন। সবাই জানতেন এই অপকর্মের জন্য আগামেমনন দায়ী। কিন্তু একথা কেউ সাহস করে বলতে পারছিলেন না। শেষ পর্যন্ত একিলিস সাহস দিলে ও নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিলে এক ভবিষ্যতবক্তা সাহস করে আগামেমননকে বলেন যে পুরোহিতের মেয়েকে ফেরত না দিলে অ্যাপোলো মহামারী প্রত্যাহার করবেন না। আগামেমনন মেয়েটিকে ফেরত দিতে রাজি হন কিন্তু তার বদলে ব্রিসেইসকে চেয়ে বসেন। গ্রিক বাহিনীর সম্মিলিত প্রস্তাবে একিলিস ব্রিসেইসকে আগামেমননের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হন। এই ঘটনায় অপমানিত একিলিস ঘোষণা করেন যে তিনি ট্রয়যুদ্ধে অংশ নেবেন না।

একিলিসের শ্রেষ্ঠ বন্ধু ছিলেন প্যাট্রোক্লেস। ট্রোজান বীর হেকটর তাকে যুদ্ধে হত্যা করেন। বন্ধুর মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে তখন প্রতিজ্ঞা ভেঙে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন একিলিস। শুরু হয় দুই পক্ষের দুই শ্রেষ্ঠ বীরের লড়াই। একিলিসের মা তার জন্য স্বর্গ থেকে নিয়ে আসেন দেবকারিগর হেফাস্টাসের তৈরি বর্ম। তার অস্ত্রও ছিল দৈবপ্রদত্ত। তাকে সাহায্য করেন দেবী অ্যাথেনি। অ্যাথেনি তাকে নিজের অব্যর্থ বর্শা দিয়েছিলেন।

অন্যদিকে ট্রয়ের শ্রেষ্ঠবীর রাজপুত্র হেকটর কোনো ডেমিগড ছিলেন না। কোনো দেবতাও তাকে সাহায্য করতে আসেননি। কিন্তু অসীম বীরত্বের সঙ্গে তিনি লড়াই চালিয়ে যান। এই যুদ্ধের দীর্ঘ বর্ণনা রয়েছে ইলিয়াডে। অবশেষে হেকটরকে বধ করেন একিলিস। তারপর বন্ধুহত্যার প্রতিশোধ নিতে হেকটরের মৃতদেহ তার রথের সঙ্গে বেঁধে ট্রয়প্রাচীরের চারপাশে ঘুরান। তার এই নিষ্ঠুর ও অমানবিক কাজে ক্ষুব্ধ হন দেবতারাও। যা হোক শেষ পর্যন্ত ট্রয়রাজ প্রায়াম যখন প্রচুর উপঢৌকন নিয়ে তার সঙ্গে গভীর রাতে দেখা করেন তখন ক্ষতক্ষিত মৃতদেহ রাজাকে ফিরিয়ে দেন একিলিস।
নারীযোদ্ধা আমাজনদের রানী পেন্থিসেলিকে ট্রয়যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত করেন একিলিস। যদিও পেন্থিসেলির সৌন্দর্যে তিনি এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে তাকে হত্যার পর দারুণ দুঃখ পান।

একিলিস ট্রয়রাজ প্রায়ামের এক কন্যাকে বিয়ে করতেও আগ্রহী হন। কিন্তু তার আগেই প্যারিসের নিক্ষিপ্ত তীর তার গোড়লি বা টেনডনে আঘাত করে। সেই আঘাতেই মৃত্যু হয় একিলিসের।

প্রেম ভালোবাসার দিক থেকে একিলিস ছিলেন ভীষণভাবে বঞ্চিত। তার ভালোবাসার পাত্রী ব্রিসেইসকে কেড়ে নেন আগামেমনন। ট্রয়রাজ প্রায়ামের কন্যাকে বিয়ের আগেই তার মৃত্যু হয়। হেলেনকে পেতে চেয়েছিলেন একিলিস। তাই ট্রয়যুদ্ধের সময় একবারের জন্য হেলেনের সঙ্গে মিলন প্রার্থনা করে মা থেটিসকে অনুরোধ করেন তিনি। থেটিস পুত্রের অনুরোধে স্বপ্নে হেলেনের সঙ্গে তার মিলনের ব্যবস্থা করেন। এইজন্য একিলিসকে হেলেনের পঞ্চস্বামীর একজন বলে ধরা হয়।

চিরবঞ্চিত, ক্ষুব্ধ, ক্রোধান্ধ বীরের প্রতীক হলেন একিলিস।

 

শান্তা মারিয়া

২৪ এপ্রিল, ১৯৭০ ঢাকায় জন্ম।
ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলে পড়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগ থেকে অনার্স ও মাস্টার্স। বাংলা একাডেমির তরুণ লেখক প্রকল্পে ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহমা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতায় নারী নেতৃত্ব বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন।

১৯৯৭ সালে দৈনিক মুক্তকণ্ঠে সাংবাদিকতা শুরু। এরপর জনকণ্ঠ, আমাদের সময়, রেডিওআমার ও চীনআন্তর্জাতিক বেতার এবং বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরডটকম-এ সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছেন। সর্বশেষ আমাদের সময় পত্রিকায় ফিচার এডিটর পদে কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে চীনের ইউননান মিনজু বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার শিক্ষক। পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোটসহ মানবাধিকার বিষয়ক বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সেমিনারে পেপার উপস্থাপন করেছেন। কবিতা, গল্প ও ভ্রমণকাহিনি প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন পত্রিকায়। এ পর্যন্ত ৫টি কাব্যগ্রন্থসহ ১২টি বই প্রকাশিত হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র, নেদারল্যান্ডস, চীন, ভারত, শ্রীলংকা, নেপাল এবং বাংলাদেশের প্রায় সবক’টি জেলায় ভ্রমণ করেছেন। জ্ঞানতাপস ভাষাবিদ ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহর পৌত্রী ও ভাষাসৈনিক এবং বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মী মুহম্মদ তকিয়ূল্লাহর কন্যা। ভ্রমণ করতে ভালোবাসেন। মিথোলজি ও ইতিহাসপাঠ শান্তা মারিয়ার প্রিয় নেশা।

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top