Well, I know now. I know a little more how much a simple thing like a snowfall can mean to a person”
―Sylvia Plath
মাঝে মাঝে এমন হয়, সকালবেলা ঘুম ভেঙে চেয়ে দেখলাম চারদিক অচেনা হয়ে আছে। জানলা দিয়ে বাইরে তাকাই, মনে মনে কল্পনা করি, শীত আক্রান্ত পাতাহীন রুক্ষ শাখাগুলো সহসা যেন কোন জাদুর কাঠির স্পর্শে পুষ্পে-পত্রে-পল্লবে রাতারাতি শোভিত হয়ে গেছে। কিন্তু আসল চেহারাটি তো একেবারে ভিন্ন। না কল্পনার বসন্তদিন আসতে এখনো অনেক বাকি। প্রতিবারের মতো এবারও হেমন্ত শেষ হলো, আর সাথে সাথে কে যেন তার সবটুকু পোশাক খুলে নিলো। বিশীর্ণ হাড়-কঙ্কাল হয়ে পথ হারানো সন্ন্যাসীর মতো সুস্মিত দিনের জন্য উদাস অপেক্ষায় চেয়ে থাকে সে। আজ যেন তা আরও বেশি করে মনে হচ্ছে।
এবার ডিসেম্বর জানুয়ারি ভালোয় ভালোয় পার করতে পারলেও ফেব্রুয়ারিতে এসে যেন আর ছাড়াছাড়ি নেই। শীতের কামড় একটানা ছক্কা পিটিয়েই চলছে। আবহাওয়া তাপমাত্রা থেকে শুরু করে, সবকিছু সেই আগের বছরের উন্মাদ শীতের চেহারা ধারণ করতে শুরু করেছে। সম্পূর্ণ শহরটা তৈরি হয়েই আছে তুষারের আলিঙ্গনে ডুবে যেতে। আর তা শুরু হয়ে গেছে বেশ জোরেশোরেই। এরই মাঝে বেরুতে হয়, জীবনের প্রয়োজন তো বসে থাকে না। তাই পা বাড়াতে হয় ঝরঝর ঝরে পড়া তুষার-বৃষ্টির ভেতরেই। তবে অবিরাম মুষলধারা বৃষ্টি আর অবিরাম তুষারপাত কিন্তু একেবারেই এক জিনিস নয়। তবুও সেও মুষলধারা বৈকি।
সোয়া দু’শো বছরের পুরানো এই টরন্টো শহর, যেখানে আমি থাকি। প্রায় সাড়ে ছয়শ স্কয়ার কিলোমিটারের এই শহরটি কানাডার সবচেয়ে বৃহৎ নগরী, অন্টারিও প্রভিন্সের রাজধানী। এখানে প্রকৃতির প্রতিটি রূপই বড়ো বেশি স্পষ্ট। এই যেমন এখন শীতকাল, আর উত্তর আমেরিকার শীত মানেই তো কনকনে সাদারাজ্যে ডুবে যেতে যেতে বেঁচে থাকা। অন্তত আমার তাই মনে হয়। প্রতিটি শীতকালেই একই কষ্ট, একই চেহারা, একই অসহায়ত্ব। এই যেমন আজ সকাল থেকে একটানা বৃষ্টির মতো ঝুমঝুম করে তুষার ঝরছে। আচ্ছা এটাকে কি ঝুরঝুর বললে ঠিক শোনাতো? সে যাই শোনাক, খুব ইচ্ছে হচ্ছে বৃষ্টির সঙ্গে মিলিয়ে বলি। তাতে করে এই প্রকৃতিকে আপন করে নিতে পারি কিনা দেখি। হয় না, কিছুতেই হয় না। শিকড় বেড়ে ওঠার একটি বিশাল রসায়ন আছে বৈকি। আমার শিকড় পুষ্ট হয়েছে, বেড়েছে শ্যামল বাংলার মাটিতে। তাই সেখানকার জল-হাওয়া-প্রকৃতি আমাকে বৃষ্টি চিনিয়ে চিনিয়ে বড়ো করেছে। চিনিয়েছে সবুজ রঙের প্রভা। প্রকৃতি বলতে আমি সবুজকে চিনি। তাহলে কেমন করে আপন হবে এই সাদা বরফ, কনকনে হাওয়ার হিম পাগলামি?
এরই মাঝে ভিজতে ভিজতে বেরিয়েছি সেই সাত সকালে। আজকের এই বের হওয়াটা আমার সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ঘুরন। একে আমি ভ্রমণ বলতে রাজি নই, তাই এটি ঘুরন। বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে, হিম ধরা বাতাস আর ঝিরিঝিরি তুষারে মুড়ে অপেক্ষা করেছি বাসের জন্য। হাঁটাহাঁটি করে নিজেকে উষ্ণ রাখতে চেষ্টা করে যাচ্ছি যথাসাধ্য। বাস এলো।
ড্রাইভার ভদ্রমহিলা আমাকে গুডমর্নিং জানাতেই হেসে বলি,
– ইয়েস, ইট ইজ রিয়েল গুডমর্নিং!
আমার এহেন রসিকতায় চালকও হেসে দেন। বাসের প্রতিটি জানালা ঘোলা হয়ে আছে। বাইরের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। শুধু সামনের বিশাল উইন্ড-শিল্ডে অবিরাম ওয়াইপার চালিয়ে স্নো সরানো চলছে। আজকে অনেকগুলো কাজ নিয়ে বেরিয়েছি। প্রায় সারাদিন লেগে যাবে সেসব সারতে। সকালের মেঘাচ্ছন্নতা দুপুরেও শেষ হল না। তারই মাঝে আবারো দুপুরের পর পরই বেরুতে হলো। কিছু কাজের জন্য বরফের ডুবে যাওয়া পথ ধরে বেশ কিছু দূর হাঁটতে হলো। মনও যেন তুষারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঝরছে।
এবারে বড়োদিন, নতুন বছর সব মিলিয়ে মনের সাধ মিটিয়ে স্নো-ফল পায়নি বলে অনেক সাদা বন্ধুর মুখ বেজার দেখেছি। বেশ ক’দিন পর আজ আবার সকাল থেকে এই খেলা শুরু হয়েছে। আমি সেই ঝরে পড়া তুষারের পর্দা সরিয়ে সরিয়ে হাঁটছি অনেকটা পথ, বসছি কফি শপের উষ্ণতায়, গরম কফিতে চুমুক দিতে দিতে কাচের জানালা দিয়ে চেয়ে দেখছি ঝুর ঝুর ঝরে পড়া কত না বরফ-তুলো। দেখছি- স্টেশন, পথমোড়, বাস ও ট্রামের আনাগোনায় তুষার-বৃষ্টির আলিঙ্গনে কী করে সন্ধ্যা নামে এই শহরে। আর সেসব আমার স্যামসান গ্যালাক্সি সেলফোনের ক্যামেরার বোতাম টিপে তু্লে নিচ্ছি, ঝটপট চালান করে দিচ্ছি মেমোরি চিপের গোলাঘরে।
চলে যাই পুবের জংশনে
সাদা বরফে ঢেকে গেছে মর্নিংসাইড অ্যাভিনিউর দুপাশ। এই রাস্তা আমার ঘরে ফেরা এবং বাইরে বেরুবার অন্যতম পথ। যে পথ ধরে চলে যাই পুবের জংশন কেনেডিতে। সে পথ সহসা আজ অচেনা হয়ে উঠতে চায়। ঢেকে গেছে সাদা চাদরের আস্তরে। বাড়ির ছাদ, গাছের ডাল, স্কুলের মাঠ, ফুটপাথ সবকিছু চাপা পড়েছে তুষারে তুষারে। মেঘলা আকাশের বুকে গুঁজে থাকা জলকণা নামতে না নামতে বরফ হয়ে যাচ্ছে। দখল করে নিচ্ছে আমার জ্যাকেট, টুপি, সাইড ব্যাগ, স্নো-বুট। আমি হাত মোজা পরতে পারি না, তাই এই মোক্ষম শীতেও আমার নগ্ন দুহাত লুকিয়ে রাখি ভারি উইন্টার-জ্যাকেটের পকেটে। মাঝে মাঝে সাহস করে হাত পেতে তালুতে ধরছি ঝরে পড়া ধু ধু তুষারের অমল ধবল গুচ্ছ। এমনতো নয় এই-ই প্রথম, তবু আমার প্রতি শীতে নতুন করে চেনাজানা হয় স্তূপ স্তূপ বরফের সঙ্গে। যেন এই প্রথম দেখলাম তার ঝরে পড়া, যেন এই-ই প্রথমবারের মতো পরিচয় হল আমাদের! বরফের দেশে এই বারো বছরেও তার সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে উঠল না। আর তাই শীতকাল এলে মনটা কখন যে পালাই পালাই করে, নিজেও জানি না।
কিন্তু প্রতি বছর তো আর পালানো হয় না, হবেও না। কিন্তু ইচ্ছেটা থেকেই যায়। দেশে যাবার ইচ্ছে, অথবা দক্ষিণ আমেরিকা, নিদেন পক্ষে নাতিশীতোষ্ণ কোনো অঞ্চলে চলে যেতে ইচ্ছে করে। সাগরের কাছাকাছি দ্বীপগুলো শীতকালে খুবই আরামদায়ক। যাব যাব করেও, কোথায় আর যাওয়া হচ্ছে? এর প্রথম ও প্রধান কারণ- দেশ ডাকে। বলে, আয়, আমার বুকে আয়। তাই হয় না যাওয়া ইতিউতি অন্য কোথাও। বিশেষ করে শীতে। ডিসেম্বর বিজয়ের মাস, ফেব্রুয়ারি ভাষার মাস আর মার্চ স্বাধীনতার মাস। পরপর মাসগুলো মগজের তারে তারে বেহালা বাজায়, ডাকে। বড্ড আচ্ছন্ন করে রাখে। আমি যেতে পারি বা নাই পারি।
স্টেশনের নাম ব্রডভিউ
পাতালরেলে চড়ে যে স্টেশনে এসে নামলাম তার নাম ব্রডভিউ, ডাউন টাউনের কাছাকাছি। যার আশেপাশে রয়েছে নাম করা গ্রিক-টাউন অফ ড্যানফোর্থ। অসংখ্য গ্রিক রেস্টুরেন্ট, অফিস, ইউরোপিয়ান স্টাইলের দোকানপাট। এছাড়া রয়েছে ১৯১৮-তে তৈরি ব্রিজ ‘ব্লোর ভায়াডক্ট’। খুব গুরুত্বপূর্ণ সেতু, পুবের সঙ্গে পশ্চিমের যোগসূত্র। এর উপর দিয়ে যানবাহনের চলাচল, তার ঠিক নিচ দিয়ে পাতালরেলের ঝুলন্ত সেতু, আর তার একেবারে তল দিয়ে বয়ে চলছে ডন নদী। এই ব্রিজের নিচু রেলিং আত্মহত্যা প্রবণ মানুষের বড়ো পছন্দের জায়গা। চূড়ান্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেও কখনো কখনো ঠেকানো যায়নি এই স্বেচ্ছামৃত্যু। এখন অবশ্য ব্যবস্থা আগের চেয়ে সতর্কতা অনেক জোরদার হয়েছে।
ব্রডভিউ স্টেশনে পাতালে রয়েছে পাতালরেল লাইন, আর উপরে রয়েছে বাস ও ট্রাম যোগাযোগ ব্যবস্থা। পাতাল থেকে উপরে উঠতেই দেখলাম সাদা তুষারে ঢেকে গেছে পুরো ট্রামলাইন। এখানে ট্রামকে ‘স্ট্রিট-কার’ বলে। টরন্টোর স্ট্রিট-কার ১৮৯২ থেকে বৈদ্যুতিক শক্তিতে চলছে। রেলের মতো লাইন পাতা আছে বলে শহরটাকে কোথাও কোথাও অনেক প্রাচীন বলে মনে হয়। খানিকটা প্রাচীন, খানিকটা ক্ল্যাসিক এই যানবাহনটি আজকের টরন্টো শহরের ছুটে চলা গতির সঙ্গে বেশ বেমানান। শুনতে পাই, আজকাল মাঝে মাঝে রব ওঠে বাহনটি বন্ধ করে দেবার। তারপরও স্ট্রিট-কার চলছে ডাউন টাউনের চারপাশে পুব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত। আমার কিন্তু বেশ লাগে এতে চড়ে ঘুরে বেড়াতে। বিশেষ করে যেসব দিনে হাতে সময় থাকে বা খুব মন খারাপ লাগে, সেসব দিনে আমি স্ট্রিট-কারে করে ঘুরে বেড়াই সারা শহর। মন-মনান্তর নিয়ে একটি দীর্ঘপথ পাড়ি দেই দিন-দিনান্ত শেষ না হওয়াতক।
সাদা বরফ রঙিন গ্রাফিটি
ব্রডভিউ স্টেশন থেকে বেরিয়ে পড়েছি। নর্থের দিকে হেঁটে চলছি, ঝির ঝির মিহিন তুষার আমার মাথা কাঁধ ঢেকে চলছে। যেতে যেতে যেদিকে তাকাই বরফ পরীর উড়াল হাত থেকে কারো রক্ষে নেই। এখন হাঁটতে খুব ভালো লাগছে, খুব মনে পড়ছে অনেক কিছু। নিজের মাঝে ডুবে ডুবে হেঁটে যাওয়ার এই তো সময়। একটা কফি শপ খুঁজছিলাম, এমন দিনে উষ্ণ কফি না হলে চলে কী করে! হঠাৎ চোখ চলে গেল ব্রডভিউকে ক্রস করে চলে যাওয়া ছোট্ট রাস্তা প্রিটোরিয়া অ্যাভিনিউয়ের কোণার দেয়ালে আঁকা রঙিন গ্রাফিটির দিকে। টরন্টো শহরের অসংখ্য দেয়ালে এ ধরনের গ্রাফিটি আর্ট রয়েছে। যা গ্রাফিক স্টাইল এবং কালার প্রজেকশনে এতটাই চমৎকার ও নতুনত্বের দাবি রাখে যে, মাঝে মাঝে চোখ ফেরানো যায় না।
ষাট দশকে নিউ ইয়র্কের পাশাপাশি টরন্টোতে এই শিল্পচর্চা শুরু হলেও, আশিতে এসে তা বেগবান ও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। গ্রাফিটি আঁকা প্রিটোরিয়া অ্যাভিনিউ রাস্তাটি ঢেকে আছে সাদা তুষারে, কেবল জেগে আছে রঙিন আঁকটানা দেয়ালটি। হয়তো এর চেয়েও আরও অনেক ভালো ভালো গ্রাফিটি দেখেছি, কিন্তু আজ এই অবসন্ন দিনে এই রঙিন গ্রাফিটি-টি আমাকে উষ্ণ উদ্ধারের অনুভব দিয়ে গেল। পথে পথে ছড়ানো এই চিত্রধারা হয়তো স্থায়িত্বের ধার ধারে না, কিন্তু এমন কিছু মেসেজ রেখে যায়, যার আরেক নাম জীবনের রং। বিশেষ করে যখন চারদিকে সাদায় সাদায় ভরে উঠেছে, তখন এর অর্থ আমার কাছে অন্তহীন ভালো লাগার সঙ্গী হয়ে সাথে সাথে হেঁটে চলে।
কফিশপ ও লাল ডাকবাক্স
খুঁজতে খুঁজতে গ্রাফিটির ঠিক উলটো পাড়ে পেয়ে গেলাম একটি পুরনো দিনের আমেজ-মাখা কফি শপ, নাম ‘ব্রডভিউ এস্প্রেসো’। নানা স্বাদে ও নানা গন্ধের চা-কফির জন্য এ শহরে বেশ পরিচিত। এতে ঢুকলে স্থানীয় আর্ট-কালচারের ফ্ল্যায়ার, ম্যাগাজিন, বুকলেট ও দেয়ালে ঝুলানো পেইন্টিং দেখেই বুঝে নেয়া যায় এখানে মূলত কাদের আনাগোনা।
দরজা ঠেলে ঠান্ডা থেকে ভেতরের উষ্ণতায় ঢুকে বাঁচা গেল যেন। বেশ ক’জনকে দেখলাম কফির সঙ্গে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। আবার কেউ বা সাইড লাইটের আলোতে বসে একমনে বই পড়ছে। লেখক, চিত্রকর, থিয়েটার কর্মী থেকে শুরু করে অনেকেরই প্রিয় আড্ডাঘর এটি। কফির তেষ্টাটা ততক্ষণে আরও চনমনিয়ে উঠেছে। একটি হট এস্প্রেসো কফি ও কুকিজ নিয়ে জানালায় কাছে এসে দাঁড়ালাম। তুলোর মতো বরফ উড়ছে। এখন যেটুকু ঝরছে তার অনেকটাই গলে মিশে যাচ্ছে মাটির সঙ্গে। জানালায় সিলভিয়া প্লাথ এসে দাঁড়ালেন,
“This is my first snow at Smith. It is like any other snow, but from a different window, and there lies the singular charm of it.”
― Sylvia Plath
যদিও এ আমার কবি সিলভিয়া প্লাথের স্মিথ কলেজের জানালায় থেকে দেখা প্রথম তুষারপাত নয়। এ টরন্টো শহর, আমার কাছে পুরনো হয়ে গেছে। তবু আজকে মনে হল, এই কফি শপের জানালা থেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলে, স্মিথ কলেজের জানালায় দেখা সিলভিয়া প্লাথের প্রথম তুষারপাতের মতো, কিছু ভিন্নরকম সৌন্দর্য মেশানো চারুত্ব খুঁজে পেলে পেতেও পারি। যা হয়তো খানিক আগে দেখা ওই দেয়ালের রঙিন গ্রাফিটির মতোই একটা নতুন অনুভব দিয়ে যাবে।
চেয়ে দেখলাম, জানালার ঠিক বাইরে রাখা কাঠের বেঞ্চে আসন নিয়েছে তুষার কণারা। দোকানের সামনে একটি লালরং ডাকবাক্স দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার মাথায় জমেছে বরফের টুপি। আচ্ছা, পৃথিবী সব ডাকবাক্সই কি লাল রঙের? মনে আছ, একটা সময় ছিল, যখন ডাকবাক্স, ডাকঘর আর ডাকপিয়নের সঙ্গে পারি দিয়েছি অনেকটা সময়। তখন অন্তর্জল ছিল না, আমরা চিঠি লিখতাম- উত্তরের প্রতীক্ষা করতাম। যেখানেই থাকতাম, ডাকপিয়ন হতো আপনজনদের একজন। আজকাল ইমেইলেই সব যোগাযোগ। মনে করতে পারলাম না শেষ কবে খামে করে কারো চিঠি পেয়েছিলাম! আলো থাকতে থাকতে আরও কয়েকটি ছবি তুলে নিতে চাই। কফি শেষ করে বেরিয়ে এলাম।
সন্ধ্যা নামে চৌরাস্তার মোড়ে
দেখতে দেখতে সন্ধ্যা ঘন হয়ে এলো। রাস্তায় রাস্তায় বাতি জ্বলে উঠেছে । তুষার দিনও ঠিক বাদল দিনের মতো তাড়াতাড়ি আলো কেড়ে নেয়। ঘরে ফেরা মানুষের ব্যস্ততায় মুখরিত পথ-প্রান্তর স্টেশন। আবারো ব্রডভিউ স্টেশন, তবে পাতালরেলে নয়, এবারে চেপে বসলাম ৫০৪ নং স্ট্রিট-কারে। এই ট্রাম যাবে বেশ দীর্ঘ পথ। দেড়শ বছরেরও বেশি পুরনো রাস্তা কিং স্ট্রিট ধরে টরন্টো ডাউন-টাউনের মাঝ দিয়ে, আরও পশ্চিমে ডানডাস ওয়েস্ট সাবওয়ে স্টেশনে। যেতে যেতে দুপাশে পড়বে অনেকগুলো চমৎপ্রদ রেস্টুরেন্ট-বার-কুইজিন, নাম করা আবাসিক হোটেল, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, আর্ট গ্যালারি, টরেন্টো নাইটক্লাবের সমাহার। এছাড়া শহরের ঐতিহ্যবাহী ও আকর্ষণীয় থিয়েটার হল রয়েল আলেকজান্ডার থিয়েটার, প্রিন্সেস অফ ওয়েলস থিয়েটার এবং রয় থমসন হলগুলো। যেসব হলের কথা সারা বিশ্বনন্দিত।
আজ সহসা বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে হচ্ছে না। তাই উঠে বসেছি উলটো দিকের পথে। প্রায় ঘণ্টা দুইয়েকের পথ, আজকে হয়তো আরও বেশি সময় লেগে যেতে পারে। আমার ঘুরন প্রক্রিয়ায় যাতে কোনো বাধা না আসে, সেজন্য একেবারে শেষের দিকের একটি সিটে গিয়ে বসলাম। নিরিবিলি দেখতে দেখতে যেতে চাই। সামনে পেছনে দুপাশে কাচের জানালা দিয়ে আজকের টরন্টোকে আরও একবার নতুন করে উপলব্ধি করতে চাই। তুষারপাতের জন্যে স্ট্রিট-কারের গতিও বেশ ধীর। প্রায় প্রতিটি স্টপই টাচ করছে। মাল্টি-কালচার ও ডাইভারসিটির এই দেশে কত যে হরেকরকমের মানুষ, কত তাদের ভাষা, চেহারা, বেশবাস– দেখে দেখে শেষ হয় না।
আমার ঠিক সামনের সিটে, একজন সোনালি রঙের এলোমেলো লম্বা চুলের ছেলে, পরনের রংচটা পোশাক। তার অগোছালো ভাবসাব তাকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করেছে। দেখলাম, হঠাৎ সে তার ঝোলা থেকে হারমনিকা বের করে বাজাতে শুরু করে দিলো। একটি মিষ্টি সুরের আমেজ সহসাই ছড়িয়ে গেল চারপাশে। এ দেশে কোনো কিছুতেই কেউ অবাক হয় না। তাই সেও আপন মনে বাজিয়ে চলছে, এ যেন কোনো এক ঘরছাড়া গানের সুরের মতো লাগছে। আজ এই মেঘাচ্ছন্ন দিন ছেলেটিকেও উদাস করে তুলেছে। বাইরের প্রকৃতি তার সাদা তুষার ঢেলে চলছে অবিরাম। হারমনিকার সুর কানে নিয়ে স্ট্রিট-কারে কেউ উঠছে, কেউ নামছে। কোনো অকারণ হল্লা নেই। খুব ভালো লাগছে এই সুরে সুরে চলে যেতে। যেন কোনো অচেনা কোথাও নিয়ে যাবে এই নতুন দিনের হ্যামলিনের বংশীবাদক।
চৌরাস্তার মোড়গুলোতে জমে উঠেছে যানবাহনের ভিড়। হেড-লাইটের আলো জ্বালিয়ে ছুটে চলছে ঝাঁক ঝাঁক গাড়ি। তুষার-শহরের বুক চিড়ে সকলে ছুটছে, ছুটছে সবকিছু। আমারই কোনো তাড়া নেই। আমি কেবল তাকিয়ে দেখছি এই ঊর্ধ্বশ্বাস ছুটে চলা। আজ চলেছি একবারে পশ্চিম পথে। যদিও ও-পথ আমার নয়, আমার আবাস পুবে। উলটো পথে যেতে যেতে নিজেকে আবারো নতুন করে তেপান্তর বলে মনে হল। ঘোলাটে আলোর মাঝে তুলোবরফের একটানা সমর্পণ চলছে তো চলছেই, বিরাম নেই। পুরো শহরটা বুঝি এ যাত্রায় ডুবতে বসেছে।
ফেরদৌস নাহার
ফেরদৌস নাহারের জন্ম, বেড়ে ওঠা সবই বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাতে। নেশা, দেশ-দেশান্তরে ঘুরে বেড়ানো ও বইপড়া।
ফেরদৌস নাহার বাংলা ভাষার একজন শক্তিমান কবি, প্রাবন্ধিক ও সংগীত রচয়িতা। এ পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা: ১৫টি কবিতা ও ৩টি প্রবন্ধের বই। তাঁর কবিতার ইংরেজি অনুবাদে প্রকাশিত হতে যাচ্ছে একটি ইংরেজি কাব্যগ্রন্থ। প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশ ও ভারত থেকে অসংখ্য যৌথ কবিতা সংকলন। বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীতের দল ‘মাইলস’-এর অনেকগুলো জনপ্রিয় গানের রচয়িতা তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ও কানাডা থেকে কম্পিউটার ট্রেনিং প্রোগ্রাম কোর্স করেছেন তিনি। কবিতার পাশাপাশি ছবি আঁকেন, গান লেখেন, ব্লগিং করেন, কফিশপে ধোঁয়া আর ঘ্রাণে আড্ডার ঝড় তোলেন। কিন্তু সবকিছুর উপরে এক বিশ্ব বোহেময়ান কবি আর চির তারুণ্যের নাম ফেরদৌস নাহার। মন চাইলে বেরিয়ে যান। ঘুরে বেড়ান খেয়াল-খুশি মতো, যাকে তিনি ‘ঘুরণ’ বলেন। ভালোবাসেন প্রকৃতি ও মানুষ। পথের নেশা তাকে করেছে ঘরছাড়া, ঘুরতে ঘুরতে এখন আটলান্টিক মহাসাগরের পাড়ে, কানাডায়। সেখানে জীবন যাপনের পাশাপাশি জীবন উৎযাপন করেন কবিতা এবং লেখালিখির খরস্রোতা নদীতে বৈঠা বেয়ে। ইমেইল : [email protected]
পথে প্রান্তরে ঘুরে ঘুরে জীবনের রসদ কুড়িয়ে নেওয়ার ঝোঁক যার রক্তে দোলা দেয়। পথ যাকে বরাবরই হাতছানিতে ডাকে…ঘরে তার মন টেকা দায়।বেড়িয়ে পড়েন তিনি- প্রকৃতি হয়ত তখন অতটা সদয় নয়; হয়ত উপুড় করে ঢেলে দিচ্ছে বৃষ্টির জল, কিংবা বালিশ ছেঁড়া তুলোর মতো ঝুমঝুম(কবি’র কাছ থেকে মারিং শব্দ) তুষার কণা– থোড়াই কেয়ার তাতে! মন তো তার উড়ু উড়ু। হাঁটা পথে বাঁধা? কুছ পরোয়া নেই, চড়ে বসেন বাসে কিংবা ট্রামে। তুষারে মোড়া বিষণ্ন দিনের বুক পকেটে খুচরো মন খারাপ গুঁজে দিয়ে মনে মনে হয়ত বলে বসেন- ‘চল পানসি বেলঘরিয়া!’ কিংবা ‘– ইয়েস, ইট ইজ রিয়েল গুডমর্নিং!’ এমন সম্ভাষণে তুষারক্লান্ত দিন কী লজ্জা পায়! সূর্য মেঘের আঁচল ছেড়ে তড়িঘড়ি দেখা দেবার জন্যে কী পথে নামে? হয়ত, হয়ত না— কিন্তু ফেরদৌস নাহারের প্রাণশক্তি তাতে টাল খায় না। পথ কিংবা প্রকৃতির ভ্রুকুটির তোয়াক্কা না করে তিনি আবার পথে নামার ছক কষেন– আবার লেখা হয় এমন চমৎকার একটা লেখা। খুব ভালো লেগেছে লেখাটা। তাই এত বকবক করলেম।:)
অশেষ ধন্যবাদ, শুভকামনা ও ভালোবাসা তৃণা। আমার এই ঘুরন-গদ্য যে একজন পাঠকের কলম থেকে এতো কিছু লিখিয়ে নিতে পারে তা জেনে আপ্লুত হলাম।