ললিতা: ভ্লাদিমির নভোকভ

ভূমিকা

 

‘‘ললিতা অথবা এক বিপত্নীক শ্বেতাঙ্গের স্বীকারোক্তি’’- এই শিরোনামে দুইটি অদ্ভুত নোট হাতে পেলাম একদিন। যার লেখক ‘হামবার্ট হামবার্ট’ নামে এক ভদ্রলোক, পুলিশের কাছে বন্দী থাকা অবস্থায় গত ১৬ নভেম্বর ১৯৫২ সালে হৃদযন্ত্রের সমস্যায় (করোনারী থ্রম্বোসিস) মারা যান। কিছুদিন আগেই তাঁর বিচারের কাজ শুরু হবার কথা ছিল। তাঁর আইনজীবী ক্ল্যারেন্স সি. ক্লার্ক (বর্তমান কলম্বিয়া জেলা বারে কর্মরত আছেন) আমার বেশ ভাল বন্ধু ও আত্মীয়, ঘনিষ্ঠতার সুবাদে এই খসড়া নোটগুলো আমাকে সম্পাদনা করতে বললেন। যতটুকু জানতে পারলাম, লেখকের শেষ ইচ্ছা ছিল তাঁর মৃত্যুর পরে এই খসড়াগুলোকে একটি বই আকারে প্রকাশ করা। বই হিসেবে প্রকাশ উপযোগী করতে যে কোনো রকম সম্পদনার অধিকার মি. ক্লার্ককে সম্পূর্ণভাবে দেয়া ছিল। আর মি. ক্লার্ক এসে দায়িত্বটা আমাকে দিতে চাইলেন। উনার এমন প্রস্তাবে আমি কিছুটা অবাকই হলাম। কারণ এমন একজনকে সম্পাদক হিসেবে পছন্দ করেছেন (আমাকে অবশ্যই) যে কিনা কিছুদিন আগে পলিং পুরস্কার পেয়েছে বিকৃত মনস্তত্ত্ব ও অসুস্থ কামনা নিয়ে করা একটা কাজের জন্য। (কোনো মানে হয় এর?)

অবশ্য যতটা ভেবেছিলাম আমরা তত কঠিন কিছু ছিল না। কাজটা ধরে দেখলাম প্রত্যাশার চেয়ে অনেক সহজ ও সাবলীল। সংশোধনের পরে পরিবর্তন করার তেমন কোনো সুযোগ ছিল না আমার। সেটাও অনেক সতর্কতার সাথে করতে হয়। সম্পূর্ণ পান্ডুলিপিতেই ‘হামবার্ট হামবার্ট’ এর নিজস্ব স্বাদ ও ছাপ ছিল। আর পুরো গল্পটাই ছিল তাঁর নিজস্ব অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ। সুতরাং এমন কিছু করার সুযোগ ছিল না, যাতে তাঁর নিজস্বতাগুলো সামান্যতম ম্লান মনে হয়। গল্পের চরিত্রগুলোর ছদ্মনাম ব্যবহারের অনুমতি ছিল। তবে লেখক এই উপন্যাসের বিশেষ একটি নাম পরিবর্তন না করতে অনুরোধ করে যান। ‘হেজ’ নামটা উপন্যাসের নায়িকা চরিত্রের পদবী। আর নায়িকার প্রথম নাম তো স্পষ্টতই উপন্যাসের নামটাই- ‘ললিতা।’ লেখকের কাছে এই নামটা এতই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে, কোনো নামেই একে পরিবর্তন করার অনুমতি ছিল না আমদের। ‘হেজ’ এর ‘এইচ’ শব্দটা থেকেই যে লেখক তাঁর ছদ্মনাম ‘এইচ এইচ’ ব্যবহার করেছেন সেটাও আন্দাজ করে নিতে কষ্ট হয়নি। অবশ্য এই নামটাকে পরিবর্তনের কোনো কারণ বা ইচ্ছাও ছিল না আমার। ফলে লেখকের ইচ্ছা অনুযায়ী নামটা অপরিবর্তিতই থেকে যায়। সম্পাদনা করার সময় ‘হামবার্ট হামবার্ট’ এর অপরাধ ও সমস্ত ঘটনাটি বোঝার জন্য  ১৯৫২ এর সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের খবরের কাগজগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তে হয় আমাকে। তাঁর কিছু কিছু ঘটনা তখন খবরের কাগজে বেশ হইচই ফেলে দিয়েছিল।

আমার ভয় ছিল অন্যখানে। লেখকের ঘটনা ও চরিত্রগুলো সরাসরি উপস্থাপন করাটা তাঁর আত্মীয় ও পরিচিতদের জন্য অসম্মানজনক হয়ে যেতে পারে। তাই হামবার্ট হামবার্ট ভদ্রলোকের আত্মীয় বা পরিচিতদের কথা ভেবে অনেক কিছুই পরিবর্তন করতে হয়। রামসডেল থেকে মিঃ উইন্ডমুলার এর পাঠানো কিছু তথ্য যাচাই করে চরিত্রগুলোকে খানিকটা অন্যভাবে, অন্য নামে উপস্থাপন করতে হল আমাকে। অনেক পাঠককেই দেখা যায় উপন্যাসের চরিত্রের পিছনে আসল চরিত্রগুলো খুঁজে নিতে আগ্রহী থাকে। তাদেরও সম্পূর্ণ নিরাশ না করে বেশ জটিলতার সাথে পাণ্ডুলিপিটা সম্পাদনা করলাম। মিঃ উইন্ডমুলারের তথ্যগুলো হাতে পাবার পরে লক্ষ্য করলাম উনার মেয়ে ‘লুইস’ এখন কলেজে অধ্যায়নরত। ‘মোনা ডাহল’ নামে প্যারিসে তার এক ছাত্রী আছে। ‘রিতা’ বর্তমানে ফ্লোরিডায় এক প্রভাবশালী হোটেল মালিকের স্ত্রী। আর ‘মিসেস রিচার্ড এফ শিলার’ ১৯৫২ এর বড়দিনে মেয়েশিশু জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেছেন। ‘ভিভিয়ান ডার্কব্লুম’ সংক্ষিপ্ত  আকারে একটি লেখা প্রকাশ করেছেন বলে জানা গেল। লেখাটার নাম ছিল, ‘আমার কুই’। ‘কুই’ উপন্যাসের গুরুত্বপূর্ণ এক চরিত্রের ডাকনাম। সবকিছু বিবেচনা করে যেসব তথ্যে তাদের পরিবারের দুর্নাম হতে পারে আর সমাজের কাছে তাদেরকে আপত্তিকর করে তুলতে পারে সেগুলো সম্পূর্ণ এড়িয়ে যেতে হল।

শেষমেশ সবকিছু মিলিয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম কিছুটা বাস্তবতা ছেঁটে ‘ললিতা’ কেবলমাত্র একটি আবেগময় উপন্যাস হিসেবেই পাঠকের কাছে পৌঁছে দেব। সত্যি বলতে কী পুরো পাণ্ডুলিপিতে একটা সামান্য বিষয়ও আমার কাছে অশ্লীল মনে হয়নি। কোনো বাজে শব্দ ব্যবহার করা হয়নি। তবুও  পাণ্ডুলিপিটা যাতে বই আকারে প্রকাশ না পায়, সেজন্য অনেকেই মাথা নাড়া দিয়ে উঠল। খুব সহজেই অনেকের অনেক আপত্তি ওঠে। তাদের দাবি ছিল উপন্যাসটা সম্পূর্ণই অশ্লীল ও অসুস্থ মানসিকতার। এটা উপন্যাস হিসেবে দেখা হলেও উপন্যাসের মানসিকতার সাথে পর্ণগ্রাফির কোনো পার্থক্য নেই। একে প্রকাশ করা ঠিক হবে না।

হতে পারে উপন্যাসটাতে অনেকের রুচিগত আপত্তি থাকতে পারে। আমার নিজেরও নোটগুলো পড়ে অনেকবার মনে হয়েছে হামবার্ট হামবার্ট ভদ্রলোকের কিছু কর্মকাণ্ড ও চিন্তা-ভাবনা খুবই হাস্যকর ও ঘৃণার যোগ্য। তবু তাঁর নিজস্ব গল্পের ভঙ্গি ও আঙ্গিক পরিবর্তনের পক্ষে আমি ছিলাম না। এই ব্যাপারগুলো পরিবর্তন করতে গেলে উপন্যাসের পুরো বিষয়বস্তুতেই আমার হস্তক্ষেপ করতে হতো। তাছাড়া সম্পূর্ণ উপন্যাসটাই একটা অসাধারণ সৃষ্টি, একজন মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তির চরিত্রের দুর্দান্ত প্রকাশ। এজন্য হামবার্ট হামবার্ট ভদ্রলোকের প্রশংসা না করে পারছি না। এই কাহিনীকে হারাতে দেয়া ভীষণ অন্যায় হবে। তাই আগেই বলে নিচ্ছি এই উপন্যাস পড়তে হলে এরকম মনস্তাত্ত্বিক লেখনিকে মেনে নিতেই হবে। আপত্তিগুলোকে সহজভাবে নেয়া ছাড়া এরকম শিল্পকর্মকে অনুধাবন করতে চাওয়ার কোনো মানেই হয় না। উপন্যাসটাতে বাস্তব সব অসুস্থতা, বিশ্বাসঘাতকতা, ঈর্ষা, কামনা, প্রেম-ভালবাসার আবেগগুলো নিপুণভাবে ফুটে রয়েছে। সাইকোলজিক্যাল ব্যাপার স্যাপার থাকার কারণেই হয়ত মি. ক্লার্ক সম্পাদনার গুরু দায়িত্বটি আমার উপরেই চাপিয়েছেন।

মূলত ‘ললিতা’ এমনই একটি উপন্যাস যাকে নিঃসন্দেহে একটি ‘সাইকোলজিক্যাল সার্কেল’ বা ‘মনস্তাত্ত্বিক চক্র’ বলা যেতে পারে। কাজ হিসেবে নিঃসন্দেহে নিখুঁত এক শিল্প, একইসাথে বিজ্ঞান ও সাহিত্যমানের বিচারে এই উপন্যাসের গুরুত্ব কোনো অংশে কম নয়। একজন মানুষের ভিন্ন দৃষ্টি, অসুস্থ চাওয়া-পাওয়া, এক অদ্ভুত প্রেমিকার মত ছোট্ট একটি মেয়ে, একজন বিশ্বাসঘাতক স্ত্রী, ইগোসর্বস্ব এক মা কিংবা সামগ্রিকভাবে এক হাহাকারের মত কুড়ে কুড়ে খাওয়া স্মৃতির এক অনবদ্য উপাখ্যান এই উপন্যাস। এখান থেকে আমরা গভীর সব বোধ অনুভব করতে পারি। শিখে নিতে পারি এক নতুন প্রজন্মের জন্য পৃথিবীকে উপযোগী করে তুলতে কীভাবে আমাদের সমাজ ও নিজেদের সতর্ক করা উচিত।

জন রে জুনিয়র, পিএইচডি

ওয়াইডওর্থ, মাস

 

 

প্রথম খণ্ড

 

১.

ললিতা। আমার জীবনপ্রদীপ, আমার কামনার অগ্নি, আমার আত্মা, বিশুদ্ধ এক পাপ, ল-লি-তা! নামটা যতবার উচ্চারণ করা হবে দেখবেন মুখের উপরের তালুর দন্তমূলে জিহ্বা তিনবার করে আলতো ছুঁয়ে আসছে। আর আমি যতবার উচ্চারণ করি প্রতিবার যেন ললিতাকেই ছুঁয়ে দেবার আনন্দ পাই। কত সহজ সেই স্পর্শ! কেমন স্নিগ্ধ! ল-লি-তা।

চার ফুট দশ ইঞ্চির ছোট্ট এই মেয়েটি যখন একপায়ের মোজা খুঁজতে খুঁজতে সাতসকালে ব্যস্ত থাকত, তখন ওর নাম ছিল ‘লো’, শুধুই ‘লো’। ঘরে কখনো কখনো ‘লোলা’ বলেও ডাকা হতো, স্কুলের সবাই ডাকত ‘ডলি’ বলে। পোশাকি নাম ‘ডলরিস’, ডলরিস হেইজ। আর আমার কাছে? প্রতিটি মুহূর্তে, প্রতিটি নিঃশ্বাসে ও ছিল শুধুই ললিতা।

ও কি এই জন্মেই প্রথম? নাকি আগেও এসেছিল? হয়ত এসেছিল; ‘হয়ত’ কেন বলছি! আমি নিশ্চিত সে এই পৃথিবীতে আগেও এসেছিল। আমাদের আগেও একবার দেখা হয়েছে। এবং আগেও ওকে ভালবেসেছিলাম আমি। আমার বয়সী সেই ললিতাকে প্রচণ্ড ভালবেসেছিলাম। সেও তো বহুকাল আগের কথা, আমার শৈশবস্মৃতির গল্প। একবার গ্রীষ্মের সময় সমুদ্রের ধারে তাকে দেখতে দেখতে হঠাৎ টের পাই ওকে আমি ভালবাসি। প্রচণ্ডরকম এক ভালবাসা! যে ভালবাসাকে আজও ধরে রেখেছি আমি। কিন্তু ললিতাকে আমি কখনো ধরে রাখতে পারিনি। যে হারিয়ে যাবার, সে একরাশ ভালবাসা রেখেও হারাতে পারে। তার সাথে রেখে যেতে জানে একই পরিমান অভিমানের অজুহাত।

প্রিয় পাঠক, উপস্থিত জুরি বোর্ডের ভদ্রমহোদয়-মহোদয়াগণ, ললিতাকে ধরে রাখতে না পারার অভিযোগে খুব সহজেই আমাকে একজন খুনী সাব্যস্ত করতে পারেন আপনারা। আমি একজন খুনীই বটে। হাসিমুখেই সমস্ত দায় মেনে নেব। আজ আমার কোনো আপত্তি নেই।

 

২.

আমার জন্ম প্যারিসে, ১৯১০ সালে। ফ্রেঞ্চ আর অস্ট্রিয়ান মিশেলে একজন সুইস নাগরিক। আমার রক্তে, শিরা-উপশিরায় বইছে দানুব নদীর প্রবাহ। আমার ছোটবেলার কথা মনে করলে সুন্দর একটা স্মৃতির ভেতর ডুবে যাই কিছুক্ষণের জন্য। রিভেইরাতে বিলাসবহুল এক হোটেলের মালিক ছিল আমার বাবা। আর তার বাবার ছিল ওয়াইনের ব্যবসা, আর বাবার দুই পিতামহের ছিল অলঙ্কারের দোকান ও রেশমের ব্যবসা। তিরিশ বছর বয়সে জেরোমি ডান নামে এক ইংরেজ পর্বতারোহীর মেয়েকে বিয়ে করে বাবা। বিয়ের বছর কয়েক পরেই আমার মা মারা যায়। যতদূর শুনেছি একবার পিকনিকে যাবার পরে বজ্রপাতে সেখানেই মায়ের মৃত্যু হয়। আমার বয়স তখন মাত্র তিন বছর। স্বাভাবিকভাবেই তখনকার কথা খুব একটা মনে পড়ে না। মা ফটোজেনিক ছিল, ছবি তুলতে পছন্দ করত না। তাই তার কোন ছবিও নেই আমার কাছে। মা দেখতে কেমন ছিল সেটাও মনে পড়ে না আমার। মা’র কথা ভাবলে স্মৃতিতে এক টুকরো ধূসর আলোছায়া খেলা করে শুধু, একটা অবয়ব ভেসে ওঠে, মুখ দেখা যায় না। আর কেমন গভীর একটা শূন্য অনুভূতি জাগে, এতটুকুই।

আমার মায়ের ছোটবোন সিবিল আন্টিকে বিয়ে করেছিল আমার বাবার এক চাচাত ভাই। বিয়ের কিছুদিন পরেই তাদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। তারপর থেকে আন্টি আমাদের বাড়িতেই থাকত। বাড়ির সব কাজ করত, আমার দেখাশোনা করত, তার কাছেই আমার বড় হয়ে ওঠা। কার কাছে যেন একবার শুনেছিলাম বাবার সাথে তার প্রেমের সম্পর্ক ছিল। আন্টির চোখগুলো ছিল ভীষণ সুন্দর। আমিও আন্টিকে পছন্দ করতাম, মায়ের মতই ভালবাসতাম। আন্টি কখনোই চাইতো না আমি আমার বাবার ছায়ায় বড় হই, বা বাবার মত হয়ে গড়ে উঠি। সব সময়ই চাইতো আমাকে আমার মত করে গড়ে তুলতে। আজ তার কারণেই আমার যতটুকু ‘আমি’ হয়ে ওঠা।

সিবিল আন্টির লেখালেখির অভ্যাস ছিল, কবিতা লিখত। তার মধ্যে আরেকটা জিনিস ছিল, ভয়াবহরকম কুসংস্কারে বিশ্বাস। আন্টি ভাবত আমার বয়স যখন ষোল হবে তখন সে মারা যাবে। এবং আশ্চর্যের ব্যাপার আমার ষোল বছর বয়সেই আন্টি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে। আন্টিকে যে আংকেল বিয়ে করেছিলেন, উনি আমেরিকায় থাকতেন বেশিরভাগ সময়। আন্টির সাথে ডিভোর্স হবার পরে সেখানেই থেকে যান, পারফিউমের বিশাল ব্যবসা সামলান বাকিটা জীবন।

আমার শৈশবের সময়টা একদমই মন্দ কাটেনি। তখনকার পড়া সেই বইয়ের ঘ্রাণগুলো, সাগরতীরের সুন্দর বালিয়াড়ি, বন্ধুসুলভ পোষা কুকুর, কমলালেবুর গাছ, বাগান, সমুদ্রের আবহাওয়া আর চারপাশের সুখী সুখী মুখগুলো আজও মনে পড়ে। ভীষণ আনন্দে ছিলাম তখন। আমাদের যে হোটেল ছিল সেটার নাম ছিল ‘হোটেল মিরানা’। সিবিল আন্টি মারা যাবার পরে বাবার সাথে ওখানেই আমার বেড়ে ওঠা। সেখানকার প্রত্যেকেই আমাকে আদর করত। কর্মচারী থেকে টুরিস্ট- সবারই পছন্দ ছিলাম। এমনকি যারা বাবাকে একদমই পছন্দ করতে পারেনি তারাও আমাকে পছন্দ করত, দামী দামী উপহার পেতাম তাদের কাছ থেকে।

যদিও আমার বাবাকে অপছন্দ করার তেমন কোনো কারণই থাকতে পারে না। মোটেও মন্দ কেউ ছিল না আমার। বরং অসাধারণ একজন ব্যক্তিত্ব ছিল আমার কাছে। আমার চমৎকার বন্ধু, আমার মা, আমার প্রথম শিক্ষক- সব বাবাকেই জেনেছি। উনি কখনোই আমাকে মায়ের অভাব বুঝতে দেয়নি। বাবা আমাকে সাঁতার শেখাতে নিয়ে যেত সুযোগ পেলেই, অবসরে ঘুরতে নিয়ে যেত, সাইকেল চালাতে শিখিয়েছে নিজের হাতে। মাঝে মাঝে নৌকা নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম দুজন। আমার বই পড়ার অভ্যাসটাও তৈরি হয় বাবার কারণে। সেই সময়েই ‘ডন কিহোতে’, ‘লা মিজারেবল’ এর মত চমৎকার কিছু বই পড়ে ফেলেছিলাম। বাবাকে আমি ভীষণ শ্রদ্ধা করতাম, ভালবাসতাম। হোটেলের কর্মচারীরা কেউ নিজেদের মধ্যে যখন বাবাকে নিয়ে কথা বলত আমি আগ্রহ নিয়ে কান খাড়া করে শুনতাম। বাবার মেয়েবন্ধুদের গল্প, তাঁর সুন্দর ব্যক্তিত্ব, তাঁর নামে প্রশংসা শুনতে ভাল লাগত খুব। যাকে এতটা ভালবাসি, শ্রদ্ধা করি, তাঁর নামে ভাল কথা শুনতে ভাল লাগবে এটাই স্বাভাবিক। শৈশব সময়টাই মানুষের জীবনের সেরা সময়। যার শৈশবস্মৃতি নেই তাঁর মত অভাগা আর কে আছে? আমার সুন্দর শৈশবের পিছনে আমার বাবার অবদান সবচেয়ে বেশি।

কয়েক মাইল দূরেই একটা ইংরেজি স্কুল ছিল। সেখানেই পড়াশুনা করি তখন। পড়াশুনায়ও ভাল ছিলাম, খেলাধুলাও করতাম নিয়মিত। তাতে অল্পদিনেই সহপাঠী, স্যার সবার সাথেই আমার ভাল সম্পর্ক হয়ে ওঠে। স্কুলে থাকাকালীন আমি এক অদ্ভুত বিষয়ের সাথে পরিচিত হই। আমার বয়স তখন কত হবে, সেদিন সম্ভবত আমার তেরোতম জন্মদিন ছিল। এনাবেলের সাথে তখনও আমার পরিচয় হয়নি। সেইদিন স্কুলের বাগানে আমেরিকান এক ছেলেকে দেখলাম লুকিয়ে লুকিয়ে পকেট থেকে একটা নগ্ন নায়িকার ছবি বের করে দেখছে। আমি স্পষ্ট মনে করতে পারি, ছবিটা দেখার পরে আমার শরীর শিউরে উঠছিল বারবার। আমার কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেমন অদ্ভুত আচরণ করছিল। মানুষের শরীরও যে এক অজানা সৌন্দর্য আর রহস্য ধরে রাখতে পারে সেদিনই প্রথম অনুধাবন করি। সেই প্রথম যৌনতা সম্পর্কে জানতে পারি আমি। তারপর অবশ্য ওই বয়সে যৌনতা সম্পর্কে যতটুকু জানা প্রয়োজন তার সবটুকুই আমি বাবার কাছ থেকে জানতে পারি। আর তার কিছুদিন পরেই হাইস্কুলে পড়াশুনার জন্য আমাকে লিয়নে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সময়টা ছিল ১৯২৩ সাল। বাবা আমাকে লিয়নে পাঠিয়ে দিয়ে এমমি ডি আর এবং তাঁর মেয়ের সাথে ইটালি ঘুরতে চলে যায়। একা লাগত খুব, কিন্তু একাকীত্বের কষ্ট কেউ ভাগ করে নেবার ছিল না তখন।

 

রনক জামান

 

কবি ও অনুবাদক ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৯১, মানিকগঞ্জে জন্ম।
প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থ : অগ্রন্থিত ওহী [তিউড়ি, ২০১৯] এবং
ঘামগুলো সব শিশিরফোঁটা [অনুপ্রাণন ২০১৬]

 

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top