মীনা কুমারী নায: অনিবার্য বেদনার কুসুমিত প্রাণ

ভূমিকা ও ভাষান্তর: সাবেরা তাবাসসুম

“স্যমা হুঁ ফুল হুঁ,
ইয়া রেত পে ক্যদমোকা নিশাঁ
আপকো হ্যক্ হ্যায়
মুঝে জোভী জী চাহে ক্যহলে”

মীনা কুমারী নায। আজ এই নামেই তাঁকে চিনে নিতে চাই। না কোনো দীপশিখা, না কুসুমিত প্রাণ, না বালিতে রেখে যাওয়া পায়ের ছাপ কোনো। ছোটী বহু নয়, সায়েবাও নয়। না তাঁর অভিনীত আরো বিচিত্র চরিত্র সম্ভার। রূপালী পর্দার ট্র্যাজেডি কুইনের পরিচয় থেকে একটু সময় তাঁকে সরিয়ে রাখি। উন্মুক্ত করি তাঁর কবিনাম। উর্দু কবিতার ধারায় ত্যখল্লুস গ্রহণ করে তিনি হলেন মীনা কুমারী নায। ম্যহযাবীন বানোর গন্তব্য যেন কেবল মীনা কুমারী নয়, মীনা কুমারী নায। এক অতুলনীয় অভিনয়শিল্পীর বেদনার্ত জীবন মথে তিনি হয়ে উঠেছিলেন কবি। ক্রমে তাঁর একান্ত জীবনের সঙ্গী হয়ে উঠেছে কবিতা ও মদিরা। এক আশ্চর্য সৌন্দর্য নিয়ে বেদনাকে মূর্ত করেছেন পর্দায়। আর পুরুষতন্ত্রের প্রতাপ ও প্রহারে অসম্মানিত ব্যবহৃত নিপীড়িত হতে হতে যেতে চেয়েছেন কাঙ্ক্ষিত ‘আরাম’এর পথে। কবিতা ও মদিরা যেখানে তাঁর পথ্য, মৃত্যুই দিতে পারে তাঁকে সে কাঙ্ক্ষিত আরাম। হয়তো দিয়েছিলও তাঁকে তা-ই।

ম্যহযাবীন বানো হয়ে আলী বক্স ও ইকবাল বেগমের ঘরে জন্মেছিলেন তিনি ১৯৩৩ সালের ৩১ অগাস্ট। যে জন্ম ছিল অনাকাঙ্ক্ষিত। যে জন্মছিল ঋণগ্রস্ত। যে জন্মে ছিল কেবল পরিবারের ভরণ পোষণের ভার। চার বছর বয়সে পরিবারের রুটি-রুজির দায়িত্ব নিয়েছেন তাঁর ছোট্ট কাঁধে। ধীরে ধীরে ফিল্মি দুনিয়ায় বেবি মীনা থেকে মীনা কুমারী হয়ে উঠেছেন। ভালো লাগত পড়তে, স্কুলে যেতে। কিন্তু বেশি দিন সে সৌভাগ্য হয় নি। শ্যুটিংএর সেটে বই নিয়ে যেতেন বলে হাসি-ঠাট্টাও হতো খানিক তাঁকে নিয়ে। গোটা জীবন প্রবল প্রেম, প্রেমহীন সমঝোতা আর নিষ্পেষণের ভেতর দুমড়ে মুচড়ে গেছেন। প্রচুর কামাই, তুমুল জনপ্রিয়তা, নিশ্ছিদ্র নজরদারি আর পড়ে পড়ে মার খাওয়া। বঞ্চনা ও বেদনার নির্যাস তাঁকে নিয়ে গেছে কবিতার পথে। অনিবার্য ছিল বুঝি তাঁর এ কবি-জীবন। আমরণ কবিতাই ধরে ছিল তাঁর হাত। ৩১ মার্চ, ১৯৭২ মৃত্যু চিরসখা হয়ে তাঁর করুণ হাত দুটো ধরলো এসে।

মীনা কুমারী নায, তাঁকে অনুভব করতে পারি যেন! তাঁর কবিতার রূহ্ ছুঁয়ে দিতে পারি! এক বেদনার্ত আত্মার বন্ধু হয়ে উঠছি ক্রমশ তাঁর কবিতার রস আস্বাদনে—

চাঁদ একা,
একা আকাশ
হৃদয়কে পেলাম
সে-ও একা– একা!
নিভেছে আশা
লুকিয়েছে তারা
থির থির কাঁপা
মৌন ধোঁয়াও একা।
জীবন কি
একেই বলে?
দেহ একা
আর প্রাণও একা
সহযাত্রী কেউ
মিলে থাকেও কোথাও
দুজনেই চলেছি
একা—একা।
প্রতীক্ষায় থাকো
যদি শতাব্দী ভরও
ছেড়ে যাব
এই পৃথিবী, একা।

কবির একলাপনা আর নৈঃসঙ্গ্য, কবির অভিমান ও দীর্ঘশ্বাস কবিতা হয়ে পাঠকের আত্মাকে ছুঁয়ে যায় নিশ্চয়ই। এখানে অনূদিত শায়েরীগুলো বিশ্ববাণী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত ’দর্দ ভরী শায়েরী’ থেকে নির্বাচন করা হয়েছে। মূল উর্দু থেকে অনুবাদে সহায়তা করেছেন বন্ধু সিফাত ই ইলাহী। পাঠকের আমন্ত্রণ রইল মীনা কুমারী নাযের কবিতা-জগতে। অনিবার্য বেদনার কুসুমিত প্রাণের পল্লবে।

১.
রোতে দিল হ্যঁসনে চ্যাহরোঁকো
কোই ভী না দেখ স্যকা
আঁসূ পী লেনে কা ওয়াদা
হাঁ স্যবনে হ্যরবার কিয়া।

কেঁদে চলা হৃদয় আর স্মিতমুখ
কেউই দেখতে পায় না
অশ্রু পান করার প্রতিশ্রুতি
হ্যাঁ, প্রতিবার সবাই দিয়েছিল।

২.
আচ্ছে ল্যগে হ্যায় দিলকো তেরে
মিলে ভী লেকিন
তু দিল কী হার গুজরা,
হ্যম জান হার গুজরে।

ভালোবেসেছি হৃদয় তোমার
মিলেছিও আমরা কিন্তু
তুমি হৃদয়ই হারালে,
আমি প্রাণ হারিয়েছিলাম।

৩.
মওত্ কী ব্যরফিলী রঙ্গোমে ভী
দিল ধ্যড়কনে ল্যগা
তেরে কদমোঁ কী ত্যপিশসে,
তেরী আহ্যটকে তুফৈল।

মৃত্যুর হিমশীতল রঙেও
হৃদয় কাঁপতে থাকে
তোমার পদচিহ্নের উত্তাপে
তোমার পদধ্বনির স্পন্দনে।

৪.
খুদহী কো তেজ নাখূনোঁসে
হ্যায় নোচতে হ্যায় আব
হমে আল্লাহ খুদসে ক্যায়সী
উলফত্ হোতী যাতী হ্যায়।

নিজেকেই তীক্ষ্ণ নখে
ক্ষত বিক্ষত করি এখন
হে খোদা, নিজের প্রেমে
নিজেই কেমন মগ্ন হয়ে পড়ছি।

৫.
হ্যর ন্যয়ে জ্যখমপে
অব রূহ বিল্যখ উঠতি হ্যায়
হোঁট আগার হঁসভী প্যড়েঁ
আঁখ ছ্যলক উঠতি হ্যায়।

প্রতিটি নতুন আঘাতে
আত্মা বিলাপ করতে থাকে
ঠোঁট যদি হেসেও ওঠে
চোখ জলে ভরে আসে।

৬.
কুহ্যর হ্যায়, ধুন্ধ হ্যায়,
বেশ্যক্যল-সা ধুয়াঁ হ্যায় কোই
দিল অপনি রূহ সে
লিপটা হ্যায় আজন্যবী কী ত্যরহ।

কুয়াশাচ্ছন্ন, অস্পষ্ট
আকারহীন এক ধোঁয়া
মন তার নিজের আত্মায়
লেপ্টে আছে অপরিচিতের মত।

৭.
আবলাপা কোই
ইস্ দ্যশতমেঁ আয়া হোগা
ওয়ারনা আধীঁমেঁ
দিয়া কৌন জ্বলায়া হোগা।

বিরহদগ্ধ কোনো পা
এই নিঃশূন্য জায়গায় এসেছে নিশ্চয়ই
তা না হলে এমন ঝড়ে
কেই বা আর প্রদীপ জ্বালাবে।

৮.
দিলসে অনমোল ন্যগীনে কো
ছুপায়েঁ তো কাহাঁ
বারিশে-সঙ্গ এহা
আঠ প্যহর হোতী হ্যায়।

হৃদয়ের মত অমূল্য এক সর্পিণীকে
কোথায় লুকিয়ে রাখি
পাথর-বৃষ্টি এখানে
আট প্রহর ঝরে।

৯.
হসীঁ থ্যমী হ্যায় ইন্ আঁখোমেঁ
ইঁউ ন্যমীকী ত্যরহ
চ্যমক উঠে হ্যায় আন্ধেরে ভী
রওশনী কী ত্যরহ।

আনন্দ থেমে আছে এই চোখে
এমনই বেদনা হয়ে
ঝিকিয়ে উঠছে আঁধারও
আলোরই মত।

১০.
খুদা কে ওয়াস্তে
গ্যমকোভী তুম না ব্যহলায়ো
ইসে তো ব্যহনে দো,
মেরা, এহী তো মেরা হ্যায়।

খোদার দোহাই
বেদনাকেও ফুসলিয়ে নিও না
একে তো রয়ে যেতে দাও
আমার, একমাত্র সে-ই তো আমার হয়ে আছে।

 

সাবেরা তাবাসসুম


কবিতা লেখা শুরু পিতা মোঃ সাইদুল হক ভুইয়ার অনুপ্রেরণায়। পড়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগে। এ পর্যন্ত প্রকাশিত বই ১৪টি। ১৩টি মৌলিক কবিতা এবং একটি হিন্দী ও উর্দু কবি গুলজারের কবিতার অনুবাদ-গ্রন্থ। একমাত্র পুত্রকে নিয়ে বেশিরভাগ সময় কাটে। চলচ্চিত্রের প্রতি রয়েছে তীব্র টান। সবকিছু্র বাইরে কবিতাই সাবেরার আরাধ্য ভূমি, পাশাপাশি অনুবাদ ও মুক্ত গদ্য লেখা তো আছেই।

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top