আমিরুল আলম খানের অনুবাদ: দ্য আন্ডারগ্রাউন্ড রেলরোড

পর্ব ১৪
দ্য আন্ডারগ্রাউন্ড রেলরোড

সাউথ ক্যারোলাইনা

সাউথ ক্যারোলাইনা ছেড়ে যাবার আগের রাতে রিজবে গ্রিফিন বিল্ডিং-এর ছাদে উঠে বোঝার চেষ্টা করছিল সে কত দূর থেকে এখানে এসেছে। প্রায় এক ঘন্টা সময় সে কাটিয়েছে এখানে। সিজার আর শ্যামের সাথে দেখা হবার আগে সে ঘুমুতে যাবার কথা ভাবতেও চায় নি। সময়টা সে বাচ্চা মেয়েদের হৈ-হুল্লোড়ের মাঝে কাটিয়েছে। গত শনিবার স্কুল ছুটি হবার পর মার্টিন তাকে একটা খবর জানায়। মার্টিন এখানে আগে তামাকের কাজে যুক্ত ছিল। সে বলল, যদি মনে কর কোন  শ্বেতাঙ্গ তোমাকে বদনজরে দেখছে তাহলে নিরূপায় হলে তুমি সিঁড়ি বেয়ে ছাদে চলে যেতে পার। চিলেকোঠার দরজাটায় তালা দেওয়া থকে না। যাওয়াও খুব সহজ। আর যদি কেউ জিজ্ঞেস করে কখন তুমি চলন্ত সিঁড়ি দিয়ে ১২ তলা থেকে নামবে তাহলে তুমি এলিভেটর বাদ দিয়ে সিঁড়ি ব্যবহার করবে।

সন্ধ্যায় এই দিয়ে তার দ্বিতীয় দফা উপরে ওঠা। এত উঁচু বাড়িটা তাকে অস্থির করে তোলে। ছাদে উঠলে মনে হয় লাফ দিয়ে আকাশের মেঘ ছুঁয়ে আসি। মেঘেরা কেমন উদাস এলোমেলো ঘুরে বেড়ায়! এসব দেখতে তার খুব ভাল লাগে। মিস হ্যান্ডলার তাদের বলেছিলেন, মিশরে এত বড় বড় আর উঁচু উঁচু পিরামিড কিন্তু দাসদের হাতে তৈরি। কী বিপুল আর কঠিন পরিশ্রম আর ঘাম ঝরিয়ে তবে পিরামিডগুলো নির্মাণ করেছিল তারা। পিরামিড কি এই ভবনের চেয়ে উঁচু? সেকালের ফেরাউন বাদশাহরা পিরামিডের উপর দাঁড়িয়ে কি দেখতে চাইতেন তাদের সাম্রাজ্য কত বিশাল? যতই উপরে ওঠা যায়, পৃথিবীটা তত ছোট দেখায়।

মেইন স্ট্রিটে বেশ কয়েকটা তিন-চার তলা ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। সেগুলো আগের দোতলা থেকে বেশ উঁচু মনে হয়। যেখানে এই নির্মাণ কাজ চলছে সেখান দিয়েই কোরা রোজ যাতায়াত করে। তবে কোনটাই গ্রিফিন বিল্ডিং-এর মত উঁচু নয়। হয়ত একদিন এমন উঁচু ভবন আরো কত তৈরি হবে, কোরা ভাবে। আর তখন এ তল্লাটের চেহারাই বদলে যাবে। এসব স্বপ্ন যত সে দেখে, ততই যেন শহরটা তার খুব নিজের মনে হয়।
গ্রিফিনের পুব দিকে শ্বেতাঙ্গরা একটা নতুন শহর গড়ে তুলছে। শহরের বড় স্কয়ার, হাসপাতাল, যাদুঘর সবই আছে সে পরিকল্পনায়। কোরা এগুলো পেরিয়ে পশ্চিমে চলে এলো। এখানে কালোদের বসবাস। সেখানে তাদের ডরমিটরিগুলো। এত উঁচু থেকে দেখলে কালোদের লাল লাল দালানগুলো জঙ্গলের মধ্যে ছোট ছোট বাক্সের মতো মনে হয়। বেশ লাগে দেখতে। ওখানেই কি একদিন সেও থাকার সুযোগ পাবে? রাস্তার পাশে ছোট্ট একটা ঘর। উপর তলায় বাচ্চারা ঘুমোচ্ছে। কিন্তু লোকটা এখনও ঘুমোয় নি। কোরা লোকটার মুখ দেখার চেষ্টা করছে আর ভাবছে বাচ্চাগুলোর নামই বা কি? এর বেশি আর তার কল্পনা এগোয় না। সে র‌্যান্ডেলের দিকে আঁড়চোখে তাকায়। কিন্তু সে কী দেখতে চায় সেখানে? রাত গভীর হতে থাকে আর দক্ষিণ দিকটা ঢেকে যায় গাঢ় অন্ধকারে।
আর উত্তরে? হয়ত একদিন সে উত্তরেও যেতে পারবে।
এখন বরং শ্যামের বাসার দিকে যাওয়াই সবচেয়ে ভাল হবে।
সিজার এখনো জানে না স্টেশন এজেন্ট কেন তাকে দেখা করতে বলেছে। সেলুনের পাশ দিয়ে যাবার সময় শ্যাম তাকে ঈঙ্গিতে বলেছিল, ‘‘আজ রাতে।” এখানে আসা পর্যন্ত কোরা আর কোনদিন স্টেশনে আসে নি। তবে রাস্তাগুলো তার খুব মনে আছে। এবং সেখানে পৌঁছতে তার কোন বেগ পেতে হয় নি। জঙ্গলের নানা রকম জীবজন্তুর ডাকাডাকি, পাতার মর্মর শব্দ, ঝিঁঝিঁ পোকার ঝিঁঝিঁ রব সব তাকে এখানে পালিয়ে আসার সেই রাতের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। মনে পড়ল এমনি এক রাতে পালাতে গিয়ে কীভাবে তারা লভিকে হারিয়েছিল।

গাছপালার মধ্য দিয়ে যখন শ্যামের বাড়ির জানালার আলো এসে জানান দিচ্ছিল তখন সে আরও জোরে পা চালাতে শুরু করল। আনন্দের আতিশয্যে শ্যাম তাকে জড়িয়ে ধরল। তার পরণের জামাটা ভীষণ নোংরা আর তা দিয়ে বিশ্রী গন্ধ বেরুচ্ছে। গতবারের চেয়ে বাড়ির অবস্থা এত খারাপ যে কোরা খুব অবাক হল। গোটা বাড়িটা একবারে এলামেলো। থালাবাটিগুলো নোংরা পড়ে আছে, সর্বত্র কাঠের গুড়ো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এক জায়গায় জড়া করা অনেকগুলো ময়লা জামাকাপড়। সে এক নিদারুণ অবস্থা! হেঁশেলের অবস্থা আরও খারাপ। সারা মেঝেয় ছড়িয়ে রয়েছে নানা মসলার গুঁড়ো। আর মশলাপাতির কৌটাগুলো উপুড় করা। সে ভাবল, যাবার সময় সে এগুলো গুছিয়ে দেবার জন্য প্লেসমেন্ট অফিস থেকে একটা মেয়েকে পাঠাবার জন্য সে সুপারিশ করবে।
ততক্ষণে সিজার চলে এসেছে। হেঁশেলে সে এক বোতল মদ সাবাড় করেছে। শ্যামের জন্যও সে এক বোতল এনেছে। কোরা প্রায় ভুলতেই বসেছে যে সিজার কাঠের কাজ জানে। আজকাল তার সাথে খুব একটা দেখাও হয় না। এম্পোরিয়াম থেকে সে বেশ রঙাচঙা একটা পোশাক কিনে এনেছে কোরার জন্য। কোরা খুব খুশি। নিজের জন্য একটা গাঢ় রঙের স্যুটও কিনেছে। সেটাতে তাকে মানিয়েছেও বেশ। কারো কাছ থেকে সে টাই বাধাও শিখেছে। এটা বোধহয় সে ভার্জিনিয়া থাকতে উপহার পেয়ে থাকবে। সে বিশ্বাস করত শ্বেতাঙ্গ বুড়িটি তাকে একদিন সত্যিই মুক্তি দেবেন। আর তখন সে এগুলো ব্যবহার করবে।
“কোন টেরেন কি আসবে নাকি?”
“ক’দিনে মধ্যি নাকি আসবেনে।” শ্যামের জবাব।
সিজার আর কোরা গিয়ে অন্য জায়গায় বসল।
“তুমি তো এটা নিতে চাইবে না। কোন ক্ষতি নেই।” শ্যাম বলে।
“আমরা ইকেনে থাকব, তাই ঠিক করিচি।”
“এখনি বলিনি। আমরা আগে সিদ্দান্ত নিয়ে বলব, তাই ভেবে,” কোরা যোগ করে।
শ্যাম ভাঙাচোরা চেয়ারটাতে হেলান দিয়ে বসল। তারপর বলল, “আমার ধারণা সব শুনলে তোমরা মত বদলাবে।”
শ্যাম তাদের কিছু মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করল। মেইন স্ট্রিটের আইডিয়াল বেকারি থেকে সে নিয়মিত কেনাকাটা করে।
এরপর সে আসল কথা বলতে শুরু করল। “তোমাদের সাবধান করে দেয়া দরকার যে, তোমরা রেড’স থেকে দূরে থাকবে।”
সিজার জোক করে বলল, কম্পিটিশনে ভয় পাও? ও কিছু না। শ্যামের সেলুনে কালোরা আসে না। ডরমিটরিতে যারা থাকে তারা ওখানে গিয়ে নাচানাচি করে না বা মদও গেলে না।
“ব্যাপারটা আরও খারাপ”, শ্যাম বলে। “সত্যি বলতে কি, আমিও ঠিক বুঝে উঠতে পারছি নে কী করা উচিত।” একটা অদ্ভুত ঘটনা। কালেব নামে একটা বদ লোক আছে। ড্রিপ্টের মালিক ছিল এক সময়। মদের দোকানের কাজ। ওদের সাথে না থাকলে এখানে জীবনটা আসলে কেমন তা বোঝা যায় না। কিছুদিন হল একজন ডাক্তারকে এই হাসপাতালে চুক্তিতে আনা হয়েছে। ওর নাম বেট্রাম। তিনি শ্যামের নিয়মিত কাস্টমার ছিলেন। সামাজিকভাবে তিনি উত্তরের লোকদের সাথে একদম মেশেন না। এখানকার পরিবেশ, লোকজনের আচার-আচরণ তার একদম অপছন্দ। কিন্তু হুইস্কিতে তার ভীষণ আসক্তি। পিঁপে পিঁপে মদ গেলেন। “জীবনে করেননি এমন কোন পাপ নেই। সে সব ভুলতেই এভাবে মদ গেলেন,” শ্যাম বলল।
তো এক সন্ধ্যায় তিনি এসেছেন। তিন বোতল সাবাড় করার পর তার ম্যাচাসুসেটসের কথা মনে পড়েছে। সেসব কেচ্ছা, তার মেডিকেল জীবনের কেচ্ছা আর ভার্জিনিয়ার কথা আওড়াতে লাগল। খুব কুৎসিত সব কথা। গত সন্ধ্যায় তার নারীসঙ্গের কথা তুললেন। তিনি ল্যানচেস্টার হাউজের থেকে মিস ট্রাম্বল’স হাউসে প্রায়ই যেতেন। তো সেখানে যেসব মেয়েরা বারগার্ল হিসেবে কাজ করে, তার মতে, তারা একটু গম্ভীর স্বভাবের। যেন তারা মেইন বা অনচ্ছল স্বভাবের এলাকা থেকে এসেছে।
“শ্যাম?” কোরা জিজ্ঞেস করে।
“সত্যিই আমি দুঃখিত, কোরা। সংক্ষেপে শ্যাম বলতে শুরু করল, “মিস ট্রামবলের বেশ খানিকটা প্রশংসা করে সে বলতে থাকল, “যাই কর না কেন, রেড’স ক্যাফে থেকে দূরে থেকো, যদি তোমার নিগার মেয়ের দিকে আসক্তি থাকে।” বেশ কিছু লোককে মেয়েরা তার সেলুনে নিয়ে আসে। তাদের ধারণা তাদের রক্তের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। হাসপাতাল তাদের যে চিকিৎসা দেয় সেটা আর কিছু নয়, স্রেফ চিনিগোলা পানি বা শরবৎ। আসলে এই নিগার মেয়েগুলো হয় সিফিলিসে ভুগছে, নতুবা তার ঝুঁকিতে আছে।
“তারা কি ভাবে যে, তুমি তাদের সহায়তা করছ?” শ্যাম ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করেছিল। মুখটা গম্ভীর করে রইলেন, কিন্তু তিনি কিছুই বলেননি।
বারট্রাম তাকে বলেছেন, একটা গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা চলছে। তারা খুঁজে দেখতে চেষ্টা করছেন, কীভাবে রোগটা ছড়ায়, তার লক্ষণগুলোই বা কেমন আর কীভাবে এর চিকিৎসা সম্ভব। এ শহরে কালোদের জন্য একমাত্র সেলুন রেড’স ক্যাফে। হাসপাতালে কালোদের জন্য নির্ধারিত এলাকায় সিফিলিস নিয়ে নানা গবেষণা চলছে। শ্যাম কি এটা জানে যে, আফ্রিকানদের মধ্যে ইগবো নামে একটা উপজাতি আছে ভীতিরোগে ভোগে। তারা সব সময় বিষণ্নতায় ভোগে আর হামেশাই আত্মঘাতি হয়? এরকম অন্তত চল্লিশ জনকে এই ডাক্তার সাহেব দেখেছেন যারা বন্দি থাকার চেয়ে একসাথে শিকলে বাঁধা অবস্থায় একযোগে সাগরে ঝাঁপ দিয়ে মরতে চেষ্টা করেছিল। কেমন পাগল হলে এমন উদ্ভট চিন্তা কেউ করতে পারে, ভাব তো। এসব বিষণ্নতা থেকে নিগ্রোদের রক্ষার জন্য যদি প্রজনন প্যাটার্ন বদলে দেবার কোন উপায় বের করা যেত, কেমন হত বল তো! আর অন্য যেসব প্রবণতা আছে, যেমন যৌনকর্মে ওদের আগ্রাসী স্বভাব, সেটা যদি বদলে দেয়া যেত! ওরা যে হিংস্র হয়ে ওঠে যদি সেটা দমন করা যেত! তাহলে ওদের এসব জংলি স্বভাব থেকে আমাদের মেয়েদের আমরা নিরাপদে রাখতে পারতাম। দক্ষিণে শ্বেতাঙ্গদের এসব আপদ থেকে কী করে রক্ষা করা যায় তা নিয়েই ডাক্তার বেট্রাম কাজ করছেন।

ডাক্তার সাহেব একটু সামনে ঝুঁকলেন। শ্যাম কি আজকের খবরের কাগজ দেখেছেন?
তিনি মাথা নেড়ে বোঝালেন, যে তিনি কাগজ পড়েছেন। এবার বোতলের মুখটা খুললেন।
তারপরও তিনি বললেন, দেখলেও বারের মালিকদের খুব ভাল করে খবরগুলো পড়া উচিত, বিশেষ করে সম্পাদকীয় মন্তব্যগুলো। আফ্রিকা থেকে আমেরিকা এত বেশি লোক আমদানি করেছে আর এখানে তাদের এত বাচ্চাকাচ্চা জন্মাচ্ছে যে, অনেক রাজ্যেই তারা শে^তাঙ্গদের চেয়ে সংখ্যায় বেশি। কেবল তাদের কারণেই এদের মুক্তি অসম্ভব হয়ে উঠছে। তাই পয়লা মেয়েদের, পরে যুবক-যুবতী সকলকে এমন হিসেব কষে বন্ধ্যা করতে হবে যেন তা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। তারপর তাদের মুক্তির বিষয় বিবেচনা করা যাবে। আর কেবল এভাবেই আমরা, শে^তাঙ্গরা নিরাপদ হতে পারি। জামাইকা তো বেনিনিজ আর কঙ্গোনিজে ভরে গেছে। সবই হচ্ছে খুব হিসেব কষে। আমরা যদি হিসেব কষে এসব নিয়ন্ত্রণ না করি, তাহলে কী পরিণতি হবে? যেসব তথ্য-পরিসংখ্যান পাওয়া যাচ্ছে তা থেকে স্পষ্ট যে, আগামি কয়েক বছর বা দশকে এরাই এদেশের সব হয়ে উঠবে। কিন্তু যদি সব কিছু ঠিকঠাক করা যায় তাহলে বিজ্ঞানের ইতিহাসে এটাই হবে সবচেয়ে বড় প্রকল্প। আধুনিক শল্যচিকিৎসায় নিয়ন্ত্রিত বন্ধ্যাকরণ, গবেষণা, ছোঁয়াছে রোগের প্রার্দুভাব আটকানো খুবই সম্ভব। দৈহিকভাবে অযোগ্যদের সন্তান উৎপাদন থেকে বিরত করা সম্ভব। অবাক হবার কিছু নেই যে, সাউথ ক্যারোলাইনায় দেশের শ্রেষ্ঠ চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা একযোগে এ কাজই করে চলেছে। এক নিঃশ্বাসে এত কথা বলে গেলেন ডাক্তার সাহেব।
বারের এক কোণায় যে টেবিলে ডাক্তার বাট্রাম বসেছিলেন সেখানে বেশ কয়েকজন হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল। তিনি মদের গ্লাসে শেষ চুমুক দিয়ে কেটে পড়লেন। শ্যাম খুব ব্যস্ত।
“তোমরা দু’জন তো রেড’স-এ যেতে পার। সেটাই ভাল।”
“রেড’স?” কোরা জানতে চায়।
সেটা তো সেলুনের চেয়েও বেশি। আমরা তাদের ক’ব তারা মিত্যে কয়েচে। তারা এখন ভাল নেই।”
সিজার এ কথায় সায় দিল।
“ওই সাদা ডাক্তারের চেয়ে তারা তোমাদের কথা তারা বেশি মানবে?” শ্যামের জিজ্ঞাসা। “কী প্রমাণ আছে? এসব সামলায় এ শহরে এমন কর্তৃত্ব কারো নেই। আর তার মাসুল গুণছে সবাই। অন্যান্য শহরে কালোদের একসাথে রাখা হয়। আর শুধু যে এখানেই হাসপাতাল আছে তাও না।”

এটা কী সম্ভব যে, কালোদের বিরুদ্ধে এমন অবিশ্বাস্য স্কিমের সাথে ডাক্তাররা ছাড়াও আরও বহু লোক জড়িত? নানা জায়গা থেকে কালোদের কাউকে কিনে এনে, কাউকে উদ্ধার করে এক জায়গায় জড়ো করে তাদের উপর এমন সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে? সাদারা একাট্টা হয়ে এসব করছে। তাদের কাছে সব তথ্য আছে। সবই চলছে একটা নীল নক্সা অনুযায়ী।

ডাক্তার স্টিভেনসনের সাথে দেখা হবার পর একদিন সকাল বেলায় জাদুঘরে যাবার পথে কোরার সাথে মিস লুসির দেখা হয়। তিনি কোরাকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, হাসপাতালে জন্মনিয়ন্ত্রণ প্রোজেক্ট নিয়ে সে কিছু বলেছে কি না। কোরা হয়ত এখানে কোন মেয়ের সাথে এ নিয়ে কিছু বলে থাকবে। অথবা এমনও হতে পারে, তারা কোনওভাবে সেটা জেনে ফেলেছে। যাই হোক, জানাজানিটা ভাল হয়েছে বলে এই শে^তাঙ্গিণী মত দিলেন। এ শহরে নানা কাজের সুযোগ তৈরি করা হচ্ছে। আর তাতে যোগ্যতা অনুযায়ী অনেকে কাজও পাচ্ছে।

সামাজিক অনুষ্ঠান শেষ হবার কিছুক্ষণ আগে সেই মেয়ের সেই আর্ত চিৎকারের কথা কোরার মনে পড়ল। “ওরা আমার বাচ্চাটাকে নিয়ে গেছে” বলে সে কাঁদছিল। কোন খামারের ঘটনা নয় এটা। এমন জঘন্য অপরাধ ঘটেছে এখানেই, এই সাউথ কারোলাইনায়, যেখানে কালোদের নিরাপদে থাকার কথা। বাচ্চাকে ছিনিয়ে নিয়েছিল ডাক্তাররাই, খামারে মেয়েটির আগের মনিব নয়।

সিজার বলল, “ওরা আমার কাছে জানতে চাচ্ছিল আমার বাবা-মা আফ্রিকান কোন অঞ্চলের লোক ছিল। তা আমি কী করে জানব? তা আমার নাক তো বিনিনিজদের মতই।”
“খোজা করার আগে ওরা কতই না তোষামদি কথা বলে!” শ্যাম বলল।
সিজার বলল, “আমি এ কথা মেগকে বলব। সে আর তার কিছু বন্ধু-বান্ধব প্রায়ই সন্ধ্যায় রেড’স-এ সময় কাটায়। আমি জানি সেখানে এরা এমন কিছু লোককে খুঁজে পেয়েছে।”
“মেগ কে আবার?” কোরার জিজ্ঞাসা।
“সে আমার বান্ধবী। অনেক সময় আমি তার সাথে কাটাই।” সিজারের জবাব।
“হুম, আমি সেদিন দেখলাম তুমি মেইন স্ট্রিট দিয়ে যাচ্ছিলে। তোমার সাথে একটা মেয়েও ছিল। দেখতে খুব সুন্দরী।”
“সে বিকেলটা ছিল সত্যিই সুন্দর।” জবাব দিয়ে সিজার আরেক চুমুক মদ মুখে ঢেলল। আর কোরার চোখ এড়িয়ে বোতলের দিকে তাকাল।

কাজের তেমন অগ্রগতি নেই। আর তারা অন্যান্য কালো বসতিগুলোর মনোভাব বোঝার চেষ্টা করছে। সিজার বলল, তারা চায় যে এসব কথা যেন কেউ জানতে না পারে। যে অন্ধকার জীবন থেকে আমরা পালিয়ে এসেছি তার সাথে এদের পার্থক্য কোথায়? তারা যা করছে সবই হিসেব কষে। আইন মোতাবেক আমাদের সবার নামই আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের অফিসের কেবিনেটে কাগজে লেখা রয়েছে। এখন সবার সাবধান করা দরকার।
শহরের প্রায় কাছাকাছি এসে সিজার বলল, “ওয়াশিংটন স্ট্রিটের একটা পরিবারে মেগ কাজ করে। ওই যে বড় বড় বাড়িগুলো দেখছ ওরই একটায়।”
“তুমার অনেক বান্ধবী, জানতি পেরে খুসি হলাম।”
“সত্যি!”
“আমরা কী ভুল করচি?”
“হতেও পারে। আমাদের বোধহয় এখান থেকে চলে যাওয়া ভাল। আবার নাও হতে পারে। লভি কী বলে?
কোরা কোন জবাব দিল না। তাদের আর কথা হয়নি। (চলবে)

 

আমিরুল আলম খান 

ন্ম যশোর জেলার ভারতীয় সীমান্তলগ্ন শিববাস গ্রামে ১৩৫৮ বঙ্গাব্দের ১৫ই অগ্রহায়ণ।
পড়েছেন এবং পড়িয়েছেন ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য। এরপর মাধ্যমিক শিক্ষকদের প্রশিক্ষণে যুক্ত থেকেছেন। যশোর শিক্ষা বোর্ডে প্রথমে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক পরে চেয়ারম্যান ছিলেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি অপেশাদার সাংবাদিকতায় যুক্ত গত পাঁচ দশক ধরে। ইংরেজি দৈনিকে নিউ নেশান-এ প্রায় এক দশক সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করেন। দৈনিক ইত্তেফাক, প্রথম আলো, সমকাল, বণিক বার্তায় কলাম লেখেন।

গ্রামীণ পাঠাগার আন্দোলনে যুক্ত হয়ে বাংলাদেশে গ্রামোন্নয়নের নতুন মডেল ডিহি ইউনিয়ন পাবলিক লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেন। দেশের প্রাচীনতম এবং বৃহত্তম গণপাঠাগার যশোর পাবলিক লাইব্রেরির সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

শিক্ষা, ভাষা, প্রকৃতি, কৃষি, বাস্তুসংস্থানবিদ্যায় আগ্রহী। এসব নিয়েই তার বই: বাঙলার ফল, অরণ্যের পদাবলী, পারুলের সন্ধানে, কপোতাক্ষ-মধুমতীর তীর থেকে, বিপর্যস্ত ভৈরব অববাহিকা, পারুল বিতর্ক, বাংলাদেশের শিক্ষার স্বরূপ সন্ধান এবং বিদ্যাবাণিজ্যের রাজনৈতিক-অর্থনীতি।

তাঁর অনুবাদগ্রন্থ: আফ্রিকান-আমেরিকান উপন্যাস দি স্লেভ গার্ল। হ্যারিয়েট অ্যান জেকব রচিত এই আত্মজৈবনিক উপন্যাসটি বোস্টন থেকে প্রকাশিত হয় ইনসিডেন্টস ইন দ্য লাইফ অব এ স্লেভ গার্ল শিরোনামে, ১৮৬১ সালে।

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top