পাপড়ি রহমানের স্মৃতিগদ্য: সুরমাসায়র

অচ্ছুৎ অসুখের দিনরাত্রি

ততদিনে আম্মার ট্রাংকে লুকিয়ে রাখা প্রায় সবগুলি নিষিদ্ধ বই-ই আমি পড়ে ফেলেছি। ভালো করে বুঝি বা না বুঝি পড়তে ইচ্ছে করেছে, ব্যস পড়ে ফেলেছি। ওইসব আউট বইয়ের মাঝে নজরুলের ‘মৃত্যুক্ষুধাও’ ছিল। প্রচণ্ড কাশির তোড়ে যখন আমার কচি বুক থেকে সিঁদুরের মতো লাল টুকটুকে রক্ত উঠে আসত, আমার আনসারের কথা মনে পড়তো। নিষিদ্ধ রাজনীতি করা আনসার। ব্যক্তিত্ব সম্পন্না মেঝবউ, প্যাকালে আর কুর্শির কথা মনে পড়ে যেত। চৌকোনো পাউরুটির মতো কুর্শির শরীরের গড়ন। আর যারা ক্ষুধার জ্বালা সইতে না পেরে খেরেস্তান হয়ে যায়। ক্ষুধা মিটে গেলে ফের তারা মুসলমানও হয়ে যেতে পারে।
প্রেম কি তা আমি এখনও জানিনা। বুঝিনা। আম্মা-বড়চাচিমাকে বলতে শুনেছি—
লাকি লাভে পড়ছে।
এই লাভের সঠিক অর্থ আমি জানিনা। তবে লাকি খালাম্মা বেল্লাল হজুরের লাভে পড়েই ঘর ছেড়েছিল।
আমি চুম্বন কি তাও তেমন ভালো বুঝিনা বা জানিনা, কিন্তু এটুকু বই পড়ে জানি, রুবিকে চুমু খেতে খেতে আনসারের বুক থেকে রক্ত উঠে এসেছিল। আর সেই রক্তে রুবির ওষ্ঠ রাঙা হয়ে উঠেছিল।
আমার বুক থেকে রক্ত উঠে এসে আমার ওষ্ঠ ই রাঙিয়ে দিয়ে যায়। আমার পরনের জামাকাপড়ও রক্তে ভিজে ওঠে।

আব্বা একেবারে উন্মাদ হয়ে উঠল। যে করেই হোক আমার অসুখ সারাতেই হবে। যত টাকা লাগুক আর যত বড় ডাক্তারের দরকার হোক। আব্বা বরাবরই আমাদের দুই-একটা হাঁচি হলে বা গা সামান্য গরম হলেই বড় বড় ডাক্তার কল দিয়ে বসতো। কারো অসুখে কোনো রকম অবহেলা দেখানো তার স্বভাবে ছিল না। আজ এত জীবন পার করে বুঝি, আব্বা জানতো এই পৃথিবীতে মানুষই সব চাইতে মূল্যবান। মানুষ হারিয়ে গেলে কোনো মূল্যেই তাকে আর ফিরে পাওয়া যায় না। ফলে মানুষের অনাদর করা আব্বার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব ছিল না। আব্বা আমৃত্যু পরিবারের সব সদস্যদের অত্যন্ত যত্ন করে গেছেন।

এদিকে আমার অবস্থা দিন কে দিন সঙ্গীন হয়ে উঠছে। সারাদিন কাশতে কাশতে দম ফেলতে পারি না। কাশির সংগে রক্ত পড়ারও কমতি নাই। রাত এলেই আমার ভয় লাগতে শুরু করে। কারণ রাত্তিরে কাশির বেগ বেড়ে যায়। কাশি বাড়লে রক্তের রঙটাও অত্যধিক লাল হয়ে ওঠে।
আহা, আমি না কৃষ্ণচূড়া আর শিমুলফুল এত ভালোবাসি! করটিয়ার গ্রামের বাড়ির সেই বিশাল শিমুলগাছের তলায় আমি কত সকাল একা একা কাটিয়েছি! লোহুবর্ণ সেইসব ফুলের দেহে শীতের ফোঁটা ফোঁটা শিশির মুক্তোদানার মতো লেগে থাকতো। ফুলগুলি হাতে নিলে আমার আঙুল শিশিরের জলে মাখামাখি হয়ে যেত! সেই ফুলেরা এতদিন পরে আমার বুকের গভীরে বাসা বেধেছে! আর আমি কিনা ভয়ে মরছি? আদতে আমি রক্তপাতকে ভয় করি না, ভয় করি আম্মার বিরক্তি ফুটে থাকা মুখের আদলকে। অন্ধকার রাতের অদৃশ্য ডাকিনীরা আমাকে বড় দ্রুত ধরাশায়ী করে ফেলে! ফলে রাত নামলেই আমি অবসন্ন হয়ে পড়ি। আম্মা আমার খাটের পাশে একটা এ্যালমিনিয়ামের ছোট গামলা ছাইয়ে পূর্ণ করে রেখেছে। আমি ওই ছাইয়ের গামলায় রক্তের ফুলগুলি ফেলি। তরল রক্তপুস্প দ্রুত ছাইয়ে মাখামাখি হয়ে আমার দৃষ্টির বাইরে চলে যায়। কিন্তু রাতের বেলায় আমার শরীর আর নাড়াতে পারি না। মশারি তুলে রক্তের ফুলগুলি ফেলার কোনো শক্তিই আমার থাকে না। তখন ভারি বিচ্ছিরী কাণ্ড ঘটে যায়। আমার রক্তকাশি বিছানা-বালিশ-চাদর-মশারিতে মাখামাখি হয়ে যায়। আর আম্মাকে সেসব পরিস্কার করতে হয়ে। আম্মা কঠিন মুখ করে সেসব ধুতে নিয়ে যায়। আম্মার কষ্ট দেখে আমার চোখ ছাপিয়ে জল নামে। পাতারপাহাড় থেকে এমন এক লাল টুকটুকে রোগ বাধিয়ে আসব, আমি তা কস্মিনকালেও ভাবিনি। আহা! কীসব সুখের দিন! চোখ ভরে সবুজ দেখা, দেখা তো নয় যেন মুঠো মুঠো সবুজ পেটপুরে খেয়েও নেয়া।
আর কারাগার থেকে আমার প্রথম মুক্তি। সতেজ হাওয়ার মাঝে ডুবে থাকা রঙিন প্রজাপতির ডানা-মেলা- দিনগুলি!

বার্ষিক পরীক্ষার পরে শীতের ছুটি চলছে বলে এখন আমার ইশকুলে যাওয়ার হ্যাপা নাই। কিন্তু কলোনীর খেলার সাথীরা আমাকে আর খেলার জন্য ডাকছে না। ইতোমধ্যে হয়তো ওরা জেনে গেছে আমার কঠিন অসুখ করেছে। একদিক থেকে এই বরং ভালো হয়েছে। আব্বা-আম্মা কেউ চায়না আমি ওদের কারো সাথেই মিশি। ইশকুলের বন্ধুদের ছাড়া আব্বা-আম্মা আর কারো সাথে আমাকে মিশতে দিতে চায় না। আমি তবুও মিশি বলে আব্বা আমাকে গরুপেটা করে। আর বলে, ওদের সাথে মেশার দরকার নাই।

আমার কাশিতে রক্তচিহ্ন দেখার পর থেকেই আব্বা হন্যে হয়ে সিলেটের বড় ডাক্তারের খোঁজ করতে লাগল। এবং পেয়েও গেল। ডাঃ ওয়াহিদুর রউফ চৌধুরি। সিলেটে মেডিকেল কলেজের প্রফেসর। উনি তখন বিকেলে বেলায় বাসাতেও রুগী দেখতেন। আমার গায়ে একটা সুতি চাদর পেঁচিয়ে দিয়ে আব্বা তার কাছে আমাকে নিয়ে গেল। উনি খুব যত্ন করে আমায় দেখলেন। পরদিন সিলেট মেডিকেল কলেজে আমাকে নিয়ে আব্বাকে যেতে বললেন। রক্ত পরীক্ষা ও এক্স রে করার জন্য।
ডাক্তারের নির্দেশে আমি আর আব্বা একটা প্রায়ান্ধকার কক্ষে ঢুকলাম। একটা অচেনা লোক হাতে কী একটা নিয়ে এসে বলল—
খুকী জামাটা খুলতে হবে যে।
আমি সংকোচে প্রায় এতটুকুন হয়ে গেলাম। আমার কুঁড়িস্তন লুকিয়ে রেখে কী এক্স রে করা যায় না? আব্বা আমার সংকোচ হয়তো বুঝতে পারলো। এগিয়ে এসে যত্ন করে আমার দুইহাত উপরে তুলে জামাটা খুলে দিলো।
আব্বার ছটফটানি দেখে ডাক্তার আব্বাকে ইংরেজিতে কিসব জানি বলল। আর আব্বাও উত্তর দিলো। কিন্তু তাদের কথাবার্তার বেশিরভাগই আমি বুঝতে পারলাম না।

এই ডাক্তারকে পরে আমি চাচা বলে ডাকতাম। আব্বার সঙ্গে উনার অত্যন্ত বন্ধুত্ব হয়ে যায়। আমার চিকিৎসার কোনো ভিজিটই উনি আব্বার কাছ থেকে নেন নাই।এক সময় উনি আমাদের হাউজ ফিজিসিয়ান হয়ে যান। কারো অসুখ হলেই আব্বা উনার কাছে নিয়ে যেত। অত্যন্ত অমায়িক ব্যবহার ছিল এই ডাক্তারের। আমাকে কন্যাবত স্নেহ করে গেছেন যতদিন আমরা সিলেটে ছিলাম।

প্রেসক্রিপশন দেখে শুরু হলো আমার ওষুধ আর পথ্য খাওয়া। রোজ একটা বাচ্চা মুরগী থেতো করে গরম মশলা আর আদাজলে স্যুপ। সাথে গরমজলে গোলানো হরলিক্স, চিনি। ডিম, কলা , কমলা, আপেল প্রতিদিন। আব্বার এইসবে কঠিন নজরদারি ছিল। বাসায় যে কারো অসুখ হলেই আব্বা তাকে এক্সট্রা যত্নআত্তি করত। করতই। আলাদা স্পেশাল ডায়েট দিত। আব্বা চাইতো আমরা সবাই যেন সুস্থসবল আর হাসিখুশি থাকি।

আমাদের বাসার সবকিছুই ডিসিপ্লিনের ভেতর দিয়ে যেত। আব্বা ঘড়ি ধরে চলত। ফলে আমাদেরও চলতে হতো। ভোর ভোর ঘুম থেকে উঠে পড়তে বসা। ইশকুল না থাকলে নাস্তা খেয়ে ফের পড়ার টেবিল। একটা থেকে দুইটার ভেতর দুপুরের লাঞ্চ করে ফেলা। ছোটকার কাছে দুপুরে অংক কষা। বিকেলে দুধ-ফিরনি না হয় দুধসেমাই, আম্মার বানানো মাংসের পুর দেয়া পিঠা কিংবা মুড়িভুনা দিয়ে নাস্তা করা। ছোটকাসহ আমরা বাসায় পাঁচজন । ফলে সবকিছুই পাঁচটা করে আনা হতো বা বানানো হতো। আম্মা পাঁচটা তশতরিতে দুধের ফিরনি ঢেলে রাখতো। তশতরির উপর ঘন দুধের সর জমে থাকত।

আমাদের প্রত্যহ ভাত খাবার বাসনও ছিল পাঁচটা । তামচিনির ধবধবে শাদা বাসন। চারপাশে নীল বর্ডার দেয়া। শুধু একটা বাসন ছিল লালচে বর্ডার দেয়া। আমার অসুখ শুরু হবার পর থেকেই দেখতাম আম্মা যেন আমার কাছ থেকে অনেকটাই ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলছে! প্রথম দিকে বুঝতে পারতাম না ঘটনা কী ঘটছে? যেমন আমার গ্লাসটা আলাদা করে দেয়া। আমি ভাবতাম আম্মা হয়তো মনের ভুলে এরকম করছে! কিন্তু যতই দিন যেতে লাগলো আমার চোখে সেসব স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল। ততদিনে আমার শরীর কিছুটা সেরে উঠেছে। রক্ত পড়া বন্ধ হয়েছে, কিন্তু কাশি সারে নাই। আব্বা বরাবর পছন্দ করতো সবাইকে নিয়ে একসাথে ভাত খেতে। বারান্দায় শীতলপাটি বিছিয়ে আমরা একসাথে ভাত খেতাম। আম্মাই ভাত বেড়ে দিত আমাদের। আমি খেয়াল করছিলাম, লালচে বর্ডার দেয়া তামচিনির বাসনটাতে ভাত বেড়ে আম্মা আমাকেই দিচ্ছে হররোজ। সে এই বাসনে আর অন্য কাউকেই ভাত খেতে দিচ্ছে না। অথচ আমার অসুখের আগে এরকম আলাদা করে আমাকে খাবার দেয়া হতো না। আমি মনে মনে কিছুটা ভড়কে গেলাম। তাহলে আমার নিশ্চয়ই খারাপ কোনো অসুখ হয়েছে! আর সে অসুখটা আমাকে লুকানো হচ্ছে।
আম্মা এসব কাজ অত্যন্ত কৌশলে করত, যাতে অন্যেরা বুঝতে না পারে।
একদিন দুপুরে আম্মা যথারীতি আমাকে অচ্ছুৎ করে লালচে বর্ডারের বাসনে ভাত বেড়ে দিয়েছে। দেখে আমি জোরে কেঁদে উঠলাম। আব্বা বিস্মিত হয়ে ধমকে উঠল—
কী হইছে? কান্দস ক্যান?
আমি কোনোরকমে বলতে পারলাম—
আব্বা, আমার কি অসুখ হইছে? খারাপ কিছু হইছে?
আমার প্রশ্নে আব্বার বিস্ময় যেন আরও বেড়ে গেল!
ক্যান কী হইছে?
না, আম্মা আমার ভাতের বাসন আলাদা করে দিছে।
কে বলল? কই? দেখি?
আমি লালচে বর্ডার দেয়া প্লেটটা এগিয়ে বললাম—
এই যে এই বাসনে আমাকে রোজ খেতে দেয়।
আম্মার গৌরমুখে পলকে রক্ত জমে লাল হয়ে উঠল।
আব্বা বাস্পরুদ্ধ কন্ঠে বলল—
দেখি বাসনটা আমাকে দে।
আব্বা আর কোনো কথা না বলে চুপচাপ সেই লাল বর্ডারের বাসনে ভাত মেখে খেতে শুরু করল। আর আম্মাকে বাধ্য হয়ে একটা নীল বর্ডারের বাসনে ভাত বেড়ে আমাকে দিতে হলো।

আব্বা যেন বহু কষ্টে নিজেকে সংবরণ করে নিচ্ছে। তার মুখ নিচু করে রাখা। দুইচোখ দিয়ে টপ টপ করে জল পড়তে লাগল। আমি তো আগে থেকে কাঁদছিলাম । এক বাবা তার মেয়ের অচ্ছুৎ অসুখের তোয়াক্কা না করে , ছোঁয়াচ না বাঁচিয়ে চোখের জলে ভাত খেতে লাগল। সেইদিন থেকে আমি আমার নিজের প্লেট-গ্লাস-চায়ের কাপ সমস্তই আলাদা করে ফেলেছি। যাতে আর কাউকে আমার অচ্ছুৎ অসুখ নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে না হয়।  (চলবে)

 

পাপড়ি রহমান

নব্বই দশকের অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য একজন কথাশিল্পী। এ পর্যন্ত গ্রন্থ সংখ্যা প্রায় পঁচিশটি। কথাসাহিত্যে কাজের পাশাপাশি তাঁর রয়েছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সম্পাদনাও। বাংলা একাডেমী থেকে গবেষণা গ্রন্থ ‘ ভাষা শহিদ আবুল বরকত’ প্রকাশিত হয় ২০১০ সালে। তাঁর ভিন্নধারার উপন্যাসগুলি প্রকাশ মাত্রই বোদ্ধা পাঠকের নজর কাড়তে সক্ষম হয়। তন্মধ্যে জামদানি তাঁতিদের নিয়ে উপন্যাস ‘বয়ন’ (২০০৮) প্রকাশিত হয় মাওলা ব্রাদার্স থেকে। পালাকারদের জীবন ভিত্তিক উপন্যাস ‘পালাটিয়া’ প্রকাশিত হয় ২০১১ সালে। আট বছর বিরতির পর বেঙ্গল পাবলিকেশন্স থেকে প্রকাশিত হয় ‘নদীধারা আবাসিক এলাকা’ (২০১৯)

২০২০ সালে উপন্যাস ‘পালাটিয়া’ রি-প্রিন্ট হয় কলকাতার বনেদী প্রকাশনা সংস্থা ‘অভিযান’ থেকে।

তিনি বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ সম্মাননা পেয়েছেন ২০১০ সালে। কলকাতার ‘ঐহিক মৈত্রী সম্মাননা’ পেয়েছেন ২০১৭ সালে। ২০২০ সালে পেয়েছেন বাংলা একাডেমী পরিচালিত ‘সাদ’ত আলী আখন্দ সাহিত্য পুরস্কার’।

 

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top