ট্রান্সট্রোমারের কবিতা: পর্ব- ১

টমাস ট্রান্সট্রোমারের কবিতা অনেকেই অনুবাদ করেছেন, সে-সবের অনেকগুলো তেমন নির্ভরযোগ্য নয়। কারণ কবিতা অনুবাদ করতে গেলে তাতে এমনভাবে আকৃষ্ট হতে হয় তা যেন সেই কবিতার সাথে বসবাস  করার শামিল। তারপর যখন সেই কবিতা শর্তহীন ধরা দেয় অনুবাদকের কাছে, তখনই অনুবাদটা হয়ে ওঠে প্রাণময় । ট্রান্সট্রোমারের কবিতা অনুবাদ করতে গিয়ে নান্নু মাহবুবের ক্ষেত্রে এই ঘটনাই ঘটেছে। আশা করি পাঠক নান্নু মাহবুবের অনুবাদ পড়লেই তা বুঝতে পারবেন। ইতিপূর্বে যাঁরা ট্রান্সট্রোমারের বিভিন্ন কবিতা অনুবাদ করেছেন তাঁরাও মিলিয়ে দেখতে পারবেন নান্নু মাহবুবের অনুবাদ। যাহোক, সাহিত্য ক্যাফে ধারবাহিকভাবে ট্রান্সট্রোমারের প্রায় ৪০টি নান্নু মাহবুব অনূদিত কবিতা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করতে যাচ্ছে। তাই চোখ রাখুন সাহিত্য ক্যাফের পাতায়। ─সাহিত্য ক্যাফে

 

অনুবাদকের কথা

ট্রান্সট্রোমারের কবিতা হলো শূন্যতার কাছে একটি প্রার্থনা। আর তাঁর পৃথিবী একটা অতিজীবিত পৃথিবী, যেখানে সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডটাই সাঙ্গীতিক উজ্জ্বলতায় ভাস্বর। কখনো কখনো অবিশ্বাস্যরকম রঙিন এবং বেশিরভাগটাই স্বপ্ন আর সত্যের একটা আশ্চর্যতরল মিশেল। ট্রান্সট্রোমারের বর্ণনা সিনেম্যাটিক, একই সঙ্গে স্থির এবং তীব্রভাবে গতিশীল। সেখানে হিমতুষার নিঃশ্বাস ফ্যালে মাশরুমের ওপর, এবং তারা কুঁকড়ে যায়। খুব ভোরে যখন শঙ্খচিল চক্কর দেয় তার নিজস্ব পথে, নিচে তার বিস্তীর্ণ জলরাশি, পৃথিবীটা জলের ভেতরে একটা বহুরঙা পাথরের মতো ঘুমিয়ে থাকে, তখন তিনি কেবলই তাঁর কেন্দ্রের দিকে ডুবে যেতে থাকেন। আর এদিকে সারাদিন একটা খোলা নৌকায় খাঁড়ির ওপর ঘুরে ঘুরে শেষমেশ আমরা একটা নীল লণ্ঠনের ভেতর ঘুমিয়ে পড়ি, যখন শূন্যতা আমাদের দিকে তার মুখটি ফিরিয়ে ফিসফিস করে বলে: “আমি শূন্য নই, আমি উন্মুক্ত।”

নির্জনতা আর নৈঃশব্দ্যের দেবদূত এই স্ক্যান্ডিনেভিয়ান কবির কবিতা ইতোমধ্যে ৬০-টিরও অধিক ভাষায় অনূদিত হয়েছে।

ট্রান্সট্রোমারের বাংলা অনুবাদের ক্ষেত্রে আমি মূলত May Swenson, Robert Bly, Robin Fulton এবং কয়েকটি কবিতার ক্ষেত্রে Göran Malmqvist, Robin Robertson, Patty Crane-এর ইংরেজি অনুবাদের সাহায্য নিয়েছি। অনেক বাক্য এবং শব্দের বিভ্রান্তি কাটাতে তাঁর মূল গ্রন্থ Dikter och prosa (1954-2004) ব্যবহারেরও চেষ্টা করেছি। ─নান্নু মাহবুব

 

মলোকাই

আমরা খাড়াইয়ের ধারে দাঁড়িয়ে আছি আর আমাদের বহু নিচে
কুষ্ঠকলোনির ছাদগুলো ঝলমল করছে।

আমরা হয়তো এখান থেকে নামতে পারব কিন্তু অন্ধকার নামার
আগে আগে আবার খাড়াই বেয়ে উঠে আসতে পারব না।
তাই আমরা আবার অরণ্যের ভেতর দিয়েই ফিরি, দীর্ঘ নীল-নীল সুঁচযুক্ত
গাছগুলোর ভেতর দিয়ে হাঁটতে থাকি।

এখানে খুব নৈঃশব্দ্য, বাজপাখির আগমনের মতোই নৈঃশব্দ্য।

এই হলো সেই অরণ্য যেটা সবকিছুই ক্ষমা করে দেয় কিন্তু ভোলে না কিছুই।

ভালবেসে ডেমিয়েন বেছে নিয়েছিলেন জীবন আর বিস্মৃতি।
পেয়েছিলেন মৃত্যু এবং খ্যাতি।
কিন্তু আমরা এইসব ঘটনা উল্টো দিক থেকে দেখি: স্ফিংক্সের মুখের বদলে
দেখি পাথরের স্তূপ।

…………..

মলোকাই: Molokai; হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের অন্যতম একটি দ্বীপ। সর্বাধিক পরিচিত তার কুষ্ঠ কলোনির জন্য।
একশো বছর আগে সন্ত ডেমিয়েন (Saint Damien of Molokai) এখানে কুষ্ঠরোগীদের সেবায় জীবন উৎসর্গ
করেছিলেন এবং এখানেই তাঁর মৃত্যু হয়।

[Robin Fulton অনূদিত Molokai থেকে।]

 

কাপ্রিচোস

হুয়েলভা অন্ধকার হয়ে আসছে: কালো ধোঁয়ায় ঢাকা খেজুরগাছ
আর ট্রেনের হুইসেলের ছুটন্ত রুপোসাদা বাদুড়ের ঝাঁক।

রাস্তাগুলো সব লোকে ঠাসা।
আর ভিড়ের মধ্যিকার ব্যস্তসমস্ত মহিলাটি তার চোখের
মাপকাঠিতে সতর্কভাবে পড়ন্ত বেলার আলোটা পরিমাপ করছিল।

অফিসের জানালাগুলো খোলা। সেখান থেকে
এখনও ঘোড়ার খুরের শব্দ শোনা যাচ্ছে।
স্ট্যাম্প-খুরের সেই বুড়ো ঘোড়া।

মধ্যরাত্রির পরেই কেবল রাস্তাগুলো ফাঁকা হয়ে আসবে।
শেষমেশ অফিসগুলো সব নীল হয়ে গেছে।

উপরে ওই মহাশূন্যে:
নিঃশব্দে কদম ফেলছিল, ঘোর জ্বলজ্বলে,
অদৃশ্য আর বল্গাহীন,
সওয়ারি-ছুড়ে-ফেলা:
নতুন একটি তারকাপুঞ্জ, আমি যার নাম দিয়েছি “অশ্ব”।

………….
কাপ্রিচোস: (স্প্যানিশ) Caprichos; খেয়ালখুশি; স্প্যানিশ শিল্পী ফ্রান্সিসকো গয়ার একটি এচিং সিরিজেরও শিরোনাম কাপ্রিচোস।
হুয়েলভা: Huelva; দক্ষিণ-পশ্চিম স্পেনের একটি বন্দরনগরী।

[May Swenson অনূদিত  Caprichos থেকে।]

 

একাকীত্ব


ফেব্রুয়ারির এক রাতে আমি এখানে প্রায় মরতেই বসেছিলাম।
গাড়িটা বরফের ওপর দিয়ে একপাশে পিছলে গিয়ে রাস্তার বিপরীত দিকে
গিয়ে পড়ল। এগিয়ে আসতে থাকা গাড়িগুলো─তাদের
হেডলাইটগুলো─কাছে চলে এল।

আমার নাম, আমার মেয়েরা, আমার পেশা, সব ছিটকে গিয়ে নিঃশব্দে
পেছনে পড়ে রইল, দূরে, বহুদূরে চলে গেল। স্কুুলচত্বরে শত্রুপরিবেষ্টিত
একটা বালকের মতো আমি যেন একটা অজ্ঞাতনামা।

এগিয়ে আসতে থাকা গাড়িগুলোর আলো ছিল খুব তীব্র।
সেই আলো আমার ওপর হামলে পড়ল যখন ডিমের শ্বেতাংশের
মতো ভাসমান স্বচ্ছ একটা আতঙ্কের মধ্যে আমি পাগলের মতো স্টিয়ারিং
ঘুরিয়ে যাচ্ছি। মুহূর্তগুলো বড় হয়ে উঠল─তাদের মধ্যে জায়গা তৈরি
হয়ে গেল─ তারা হসপিটাল বিল্ডিঙের মতো বিশাল হয়ে উঠল।

একেবারে ধ্বংস হয়ে যাবার আগে
তুমি যেন থেমে গিয়ে কিছুক্ষণ শ্বাসও
নিয়ে নিতে পারতে।

তখন একটি অবলম্বন দেখা দিল: একটি সাহায্যকারী বালুকণা
বা একটা বিস্ময়কর দমকা হাওয়া। গাড়িটা মুক্ত হয়ে তীব্রবেগে রাস্তার ওপারে
ছুটে গেল। তীব্র ধাক্কায় একটা খুঁটি উপরে উঠে ভেঙে গেল─
তীক্ষ্ণ একটা ঝনঝন শব্দ হলো─আর সেটা অন্ধকারে উড়ে গেল।

তারপর সব শান্ত হয়ে এল। আমি সিটবেল্টের মধ্যে পড়ে রইলাম আর
দেখলাম কীভাবে একজন তুষারঝড়ের ভেতর
আমার অবস্থাটা দেখার জন্যে এগিয়ে এল।


বহুক্ষণ ধরে আমি
হিমজমাট ওস্টিয়েতল্যান্ডের মাঠে মাঠে হেঁটে চলেছি।
কোথাও কোনো জনমনিষ্যি চোখে পড়ে নাই।

পৃথিবীর অন্য অংশে রয়েছে সেইসব মানুষেরা,
যারা এক অবিরল ভিড়ের ভেতর জন্ম নিচ্ছে, দিনযাপন
করছে, মৃত্যুবরণ করছে।

সর্বক্ষণ দৃশ্যমান থাকতে হলে─
এক ঝাঁক চোখের ভেতর জীবনযাপন করতে হলে─
অবশ্যই একটা বিশেষ অভিব্যক্তি গড়ে উঠবে।
মৃত্তিকালিপ্ত একটা মুখাবয়ব।

গুঞ্জনের ঢেউটা ওঠানামা করে
যখন তারা নিজেদের ভেতর আকাশ, ছায়া আর
বালুদানা ভাগাভাগি করে।

সকালে দশ মিনিট এবং সন্ধ্যায় দশ মিনিট আমাকে
অবশ্যই একা হতে হবে।
─কোনোরকম পরিকল্পনা ছাড়াই।

সবাই সবার সাথে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

বহুজন।

একজন।

…………
ওস্টিয়েতল্যান্ড: (SWE: Östgötska); সুইডেনের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের একটি তুষারঢাকা বিস্তীর্ণ মাঠের অঞ্চল।

[Robin Fulton অনূদিত Alone থেকে।]

 

নীল বাড়ি

রৌদ্রোজ্জ্বল একটা রাত্রি। ঘন অরণ্যের মধ্যে দাঁড়িয়ে আমি আমার কুয়াশাচ্ছন্ন
নীল দেয়ালের বাড়িটার দিকে তাকাই। যেন আমি সদ্য মারা গেছি, এবং
বাড়িটাকে নতুন একটা দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছি।

আশিটিরও বেশি গ্রীষ্মকাল ধরে এটি দাঁড়িয়ে রয়েছে। এর কড়ি-বরগাগুলো
চারবার আনন্দ আর তিনবার বেদনায় নিষিক্ত হয়েছে। এই বাড়িতে বসবাসকারী
কারো মৃত্যু হলে বাড়িটা আবার রং করা হতো। মৃত ব্যক্তিটা নিজেই এটা রং
করত, কোনো ব্রাশ ছাড়াই, ভেতর থেকে।

বাড়িটার ওইপারে একটা খোলা আঙিনা। আগে সেখানে একটা বাগান
ছিল, এখন পরিত্যক্ত জঙ্গল। আগাছার স্থির, উত্তাল সব ঢেউ, আগাছার প্যাগোডা,
উথলে-ওঠা সব লেখা, আগাছার উপনিষদ, আগাছার একটা ভাইকিং নৌবহর,
ড্রাগনের মাথা, বল্লম, একটা আগাছার সাম্রাজ্য!

জঙ্গলাকীর্ণ বাগানটির উপর বারবার ছুড়ে দেওয়া একটা বুমেরাঙের ছায়া
ডানা ঝাপটায়। আমার সময়ের বহু আগে যে লোকটা এই বাড়িতে বসবাস করত
তার সঙ্গে এটার একটা সম্পর্ক রয়েছে। সেটা একটা শিশুই ছিল প্রায়। তার
ভেতর থেকে একটা তাগিদ নির্গত হতো, একটা চিন্তা, একটা ইচ্ছার চিন্তা:
“বানাও… আঁকো…।” তার নিয়তি থেকে বেরিয়ে আসার জন্যে।

বাড়িটা শিশুদের আঁকা একটা ছবির মতো। একটা বিকল্প শৈশবত্ব।
সেটা জন্ম নিয়েছিল কারণ কেউ একজন খুব তাড়াতাড়ি তার ‘শিশু হবার দায়িত্ব’টা
পরিত্যাগ করেছিল। দরজাটা খোলো, ভেতরে এসো! এখানে ছাদের ভেতরে
অস্থিরতা এবং দেয়ালগুলোর ভেতরে প্রশান্তি। শয্যার উপর ঝুলছে আনাড়ি হাতের
একটা পেইন্টিং, সেখানে সতেরো পালের একটা জাহাজের ছবি, হিসহিসে
ঢেউয়ের চূড়া, আর একটি হাওয়া, সোনালি ফ্রেম যাকে আটকে রাখতে পারে না।

এখানে সবসময়ই খুব ভোর─, বাঁকবদলের আগের মুহূর্তের মতো, চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের
আগের মুহূর্তের মতো। এই জীবনের জন্যে ধন্যবাদ! তারপরও আমার বিকল্পগুলোর
কথা মনে পড়ে। সব স্কেচই সত্য হয়ে উঠতে চায়।

বহুদূরে জলের ওপরে একটা ইঞ্জিন গ্রীষ্মরাত্রির দিগন্তটাকে প্রসারিত করে
দিচ্ছে। আনন্দ এবং বেদনা, দুটোই শিশিরের আতশী কাচে স্ফীত হয়ে উঠছে।
আমরা ঠিক জানি না, কিন্তু আমরা টের পাই: আমাদের জীবনের একটা সিস্টার
শিপ রয়েছে, যেটা সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা পথ পরিক্রমা করে চলেছে। যখন সূর্যটা
জ্বলছে দ্বীপগুলোর পিছনে।

…………
ভাইকিং: viking; স্ক্যান্ডিনেভিয়ার (৮ম থেকে ১১শ শতক) সমুদ্রচারী ব্যবসায়ী, যোদ্ধা ও জলদস্যুদের একটি দল।
সিস্টার শিপ: sister ship; একই ধরনের, বা একই গঠনের আরেকটি জাহাজ।

[Robin Fulton অনূদিত The Blue House থেকে।]

 

নাম

গাড়ি চালাতে চালাতে আমার ঘুম পেল এবং আমি রাস্তার পাশে গাছের নিচে
গাড়িটা দাঁড় করালাম। তারপর ব্যাকসিটে গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে পড়লাম।
কতক্ষণ? ঘণ্টাকয়েক। অন্ধকার ঘনিয়ে এল।

হঠাৎ আমি জেগে উঠলাম এবং নিজেকে চিনতে পারলাম না। পুরোপুরি
জেগে উঠেছি, কিন্তু তাতে কোনো কাজ হচ্ছে না। আমি কোথায়? কে আমি?
আমি এমন একটা কিছু যেটা একটা ব্যাকসিটে জেগে উঠেছে,
বস্তাবন্দী একটা বেড়ালের মতো আতঙ্কে ছটফট করছে। কে?

শেষমেশ আমার জীবনটা ফিরে এল। একটা দেবদূতের মতো আমার
নামটা চলে এল। দেয়ালগুলোর বাইরে একটা ভেরী বেজে উঠল (লিওনরা
ওভারচারের মতো) এবং উদ্ধারকারী পদক্ষেপগুলো দ্রুতপায়ে সুদীর্ঘ সিঁড়ি
বেয়ে নেমে এল। এটা আমি! এটা আমি!

কিন্তু বিস্মৃতির নরকে সেই পনেরো সেকেণ্ডের লড়াইটা ভুলে যাওয়া অসম্ভব,
হাইওয়ে থেকে কয়েক মিটার দূরে, যে হাইওয়ে দিয়ে হেডলাইট জ্বালানো
গাড়িগুলো সবেগে পিছলে যাচ্ছে।

………….
লিওনরা ওভারচার: Leonora Overture; Beethoven-এর একমাত্র অপেরার সূচনাসংগীত।

[Robert Bly অনূদিত The Name থেকে।]

 

শেষ বসন্ত

ফুলে ভরা আপেল আর চেরিগাছগুলো শহরটাকে মিষ্টি মলিন
মে-র রাত্রিতে সাদা লাইফজ্যাকেটের মতো ভাসিয়ে রাখছিল,
আর চিন্তাগুলো দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে যাচ্ছিল।

ঘাস এবং আগাছাদের নীরব একগুঁয়ে ডানা-ঝাপটানি।
মেলবক্সটা শান্তভাবে জ্বলে; যা লেখা হয়ে গেছে তা আর ফিরিয়ে
নেওয়া যাবে না।

একটা মৃদু শীতল বাতাস শার্টের ভেতরে ঢুকে হৃদয় হাতড়ায়।
আপেল আর চেরিগাছ, তারা নিঃশব্দে সলোমনকে নিয়ে হাসে।
তারা আমার সুড়ঙ্গের ভেতর ফোটে। তাদেরকে আমার দরকার
ভুলে যাবার জন্যে নয়, মনে রাখার জন্যেই।

…………..

সলোমন: Solomon; বাদশাহ সোলায়মান।

[Robin Fulton অনূদিত Late May থেকে।]

 

ওকলাহোমা


ট্রেনটা দূর দক্ষিণে এসে থামল। নিউইয়র্কে তুষারপাত হচ্ছিল।
কিন্তু এখানে একটা শার্ট পরেই সারারাত ঘুরে বেড়ানো যায়।
তবু কেউ বাইরে নেই। কারগুলো শুধু
উড়ন্ত সসারের মতো আলোর ঝলকানি তুলে ছুটে যাচ্ছিল।


“আমরাই সেই রণক্ষেত্র, যারা
নিজেদের বহু মৃত নিয়ে গর্বিত…”
আমি জেগে উঠতেই একটা কণ্ঠস্বর বলে উঠল।

কাউন্টারের ওপাশের লোকটা বলছিল:
“আমি এটা বিক্রির চেষ্টা করছি না,
বিক্রির চেষ্টা করছি না,
আমি শুধু এটা আপনাকে একবার দেখাতে চাই।”
এবং সে রেড ইন্ডিয়ান কুঠারগুলো দেখাল।

ছেলেটা বলছিল:
“জানি আমার একটা কুসংস্কার আছে,
আমি আর এটা রাখতে চাই না, স্যার।
জানি না আপনি আমাদের কী ভাবতেছেন?”


এই মোটেলটা একটা অচেনা খোলস। ভাড়া-করা
একটি গাড়িসহ (দরজার বাইরের বিশাল সেই শ্বেত ভৃত্য)
প্রায় স্মৃতিহীন এবং পেশাহীন আমি শেষমেশ
আমার কেন্দ্রের দিকে ডুবে যেতে থাকি।

……………

ইন্ডিয়ান কুঠার: আমেরিকান আদিবাসী কুঠার।

[Robin Fulton অনূদিত Oklahoma থেকে।]

 

গাছ এবং আকাশ

একটা গাছ বৃষ্টির ভেতর ঘোরাঘুরি করছিল,
ধূসর ঢলের ভেতর সেটা দ্রুত আমাদের
পাশ কাটিয়ে গেল। তার একটি তাড়া রয়েছে।
ফলবাগানের একটা কালো পাখির মতো সে বৃষ্টি
থেকে জীবন আহরণ করছিল।

বৃষ্টি থেমে গেলে গাছটিও থেমে গেল।
স্বচ্ছ রাত্রিগুলির ভেতরে সে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল,
আমাদের মতোই মহাশূন্যে তুষারফুল ফোটার
মুহর্তটির জন্যে অপেক্ষমাণ।

………….

[Robin Fulton অনূদিত The Tree and the Sky থেকে।]

 

বিলাপগাথা

তিনি কলমটা নামিয়ে রাখলেন।
সেটা টেবিলের ওপর স্থির হয়ে রইল।
সেটা শূন্যতার ভেতরে স্থির হয়ে রইল।
তিনি কলমটা নামিয়ে রাখলেন।

বহু কিছু আছে যা লেখা যায় না আবার গোপন রাখাও যায় না!
বহুদূরে ঘটতে থাকা কোনো কিছুর জন্যে তিনি অসাড় হয়ে ছিলেন,
যদিও আশ্চর্য ট্রাভেল ব্যাগটা একটা হৃৎপিণ্ডের মতো ধুকপুক করছিল।

বাইরে তখন গ্রীষ্মের শুরু।
সবুজ গাছপালার ভেতর থেকে কারো শিস ভেসে আসছিল─
মানুষ না পাখির?
এবং ফুলে ভরা চেরিগাছগুলো বাড়ি ফিরে আসা ট্রাকগুলোর
মাথায় মৃদু চাপড় দিচ্ছিল।

সপ্তাহ চলে যায়।
ধীরে রাত্রি নামে।
জানালার শার্সির ওপর থিতু হয় মথ:
ব্রহ্মাণ্ড থেকে আসা ক্ষুদে ক্ষুদে বিবর্ণ টেলিগ্রাম।

………….

[Robin Fulton অনূদিত Lament থেকে।]

 

লিসবন

আলফামা অঞ্চলে হলুদ ট্রামকারগুলো পাহাড়ের ঢালে ঢালে
গান গাইছিল।
সেখানে দুইটা জেলখানা। একটা তস্করদের জন্যে।
তারা গ্রিলের জানালা দিয়ে হাত নাড়ছিল।
তারা চিৎকার করে তাদের ফটো তুলতে বলছিল!

“আর এইটাতে,” দ্বিখন্ডিত একটা লোকের মতো খিকখিক করে
হাসতে হাসতে কন্ডাকটর বলছিল, “এইটাতে রাজনীতিবিদরা বসে।”
কিন্তু আমি দেখলাম শুধু অট্টালিকা, অট্টালিকা আর অট্টালিকা,
আর বহু উপরের একটি জানালায় বাইনোকুলারে চোখ লাগিয়ে
এক লোক বাইরে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।

নীলের ভেতরে ঝুলছিল ধোয়া কাপড়চোপড়গুলো।
দেয়ালগুলো ছিল উত্তপ্ত।
মাছিরা আণুবীক্ষণিক হরফ পাঠ করছিল।
ছয় বছর পর, লিসবনের এক নারীর কাছে আমি জানতে চেয়েছিলাম:
“এটা কি সত্যি ছিল, নাকি আমি এটা স্বপ্ন দেখেছিলাম?”

……………
লিসবন: পর্তুগালের রাজধানী শহর।
আলফামা: লিসবনের পার্শ্ববর্তী পুরনো একটি শহর।
দ্বিখণ্ডিত একটা লোক: en kluven människa (swidish); দ্বিখণ্ডিত কেন? সম্ভবত কন্ডাকটরের
হাসিটি ছিল Alice in Wonderland-এর হাম্পটি ডাম্পটির সেই হাসিটির মতো, আকর্ণবিস্তৃত যে
হাসিটির কারণে হাম্পটি ডাম্পটির মুখটাকে তখন অ্যালিসের কাছে দুই খণ্ড বলে মনে হয়েছিল।
১৯৭০-এর দশকে পর্তুগালের স্বৈরশাসক সালাজার আমলে রাজবন্দীদের প্রতি এই কবিতার ইঙ্গিত।
আলফামার জেলখানাগুলো তখন বাস্তবিকই বিদ্রূপের উৎস ছিল।

[Robin fulton অনূদিত Lisbon থেকে।]

 

এপ্রিল এবং নৈঃশব্দ্য

বসন্ত পরিত্যক্ত পড়ে আছে।
মখমলকালো খালটা আমার
পাশাপাশি হামাগুড়ি দেয়,
যেখানে কোনো প্রতিবিম্ব পড়ে না।

জ্বলে শুধু হলুদ ফুলগুলি।

কালো বাক্সের ভেতরকার বেহালার
মতো আমি আমার ছায়ার ভেতরে
বাহিত হই।

শুধু যে কথাটা আমি বলতে চাই
সেটা বন্ধকীর কাছে রাখা রুপোর মতো
নাগালের বাইরে ঝলমল করে।

……………

[Robert Bly অনূদিত April and Silence থেকে।]

 

কিরিয়ে

মাঝে মাঝে আমার জীবন অন্ধকারের ভেতরে তার দৃষ্টি মেলে দেয়।
এমন একটা অনুভূতি যেন অন্ধত্ব আর উদ্বেগে আচ্ছন্ন অগণিত মানুষ
রাস্তাজুড়ে কোনো এক অলৌকিক ঘটনার দিকে এগিয়ে চলেছে, যখন
আমি অদৃশ্যভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছি।

যেমন একটা শিশু তার হৃৎপিণ্ডের ভারি দুপদাপ শুনতে শুনতে আতঙ্কে
ঘুমিয়ে পড়ে। দীর্ঘ, দীর্ঘ সময়ের জন্যে, যতক্ষণ পর্যন্ত না সকাল তার
আলো ফ্যালে তালাগুলোর ভেতরে আর অন্ধকারের দরজাগুলো খুলে যায়।

…………….
কিরিয়ে: কিরিয়ে এসেছে গ্রিক শব্দ Kýrie থেকে, যার অর্থ ‘‘হে প্রভু’’ (O Lord)।

[Robin Fulton অনূদিত Kyrie থেকে।]

 

আগুনের গ্রাফিতি

বেদনাবিধুর ওই মাসগুলোতে শুধু তোমার সাথে মিলিত
হবার সময়টাতেই আমার জীবনটা জ্বলজ্বল করে উঠত।
জোনাকি যেমন জ্বলে আর নেভে, জ্বলে আর নেভে,
─আর আমরা জলপাই বনের রাত্রির অন্ধকারে
তাদের উড়ানপথের ক্ষণিক ঝলকটা অনুসরণ করি।

বেদনাবিধুর ওই মাসগুলোতে আমার আত্মা কুঁকড়ে
নিষ্প্রাণ হয়ে বসে থাকত
কিন্তু আমার শরীর সরাসরি তোমার কাছে চলে যেত।
রাত্রির আকাশ গর্জন করছিল।
আমরা চুপিচুপি মহাবিশ্বকে দোহন করে বেঁচে ছিলাম।

…………..
গ্রাফিতি: Graffiti; অনুমোদনহীন দেয়ালচিত্র।

[Robin Robertson অনূদিত Fire Graffiti থেকে।]

 

নান্নু মাহবুব

জন্ম: ১১ জুন, ১৯৬৪, যশোর। লেখালেখির শুরু ৮০’র দশকে।

প্রথম কাব্যগ্রন্থ: রাত্রিকালীন ডাকঘর (প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৫)
দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ: পুনরুত্থিত শহর (প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি, ২০০৫)
তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ: আজ কী ফুল ফুটিয়েছো, অরণ্য? (প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি, ২০১৩)

প্রতিভাস, কোলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর ইউ জী কৃষ্ণমূর্তির
সাক্ষাৎকারভিত্তিক ৪টি অনূদিত গ্রন্থ:মাইন্ড ইজ আ মিথ, নো ওয়ে আউট, থট ইজ
ইয়োর এনিমি, ও মিস্টিক অব এনলাইটেনমেন্ট।
Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top