সুধাংশু শেখর বিশ্বাসের মুক্তিযুদ্ধের গল্প: শরণার্থী

: মাপ করে দিও মা। তুমি আমারে জম্ম দিচো, পিত্থিমীর আলো দেহাইচো। গার চামড়া কুচি কুচি করে কাটে দিলিও তুমার ঋণ শোধ হবি নে। কিন্তুক মা, তারপরও কতেচি, তুমারে আর টানে নিয়ে যাতি পারতেচি নে। মাপ করে দ্যাও…

কুঁচকানো চামড়ার ভিতর থেকে কোটরাগত চোখ মেলে জুড়োনের মা ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ছেলের মুখের দিকে। কী বলছে সে, ঠিক ঠাওর করে উঠতে পারে না। নিশ্চয়ই ভুল শুনেছে।

: তুমি এহানেই থাহে যাও মা। বাঁচে থাহলি ফিরে আসে তুমারে নিয়ে যাবানে। চোখ মুছতে মুছতে আবার বলে জুড়োন মণ্ডল।

: কী কলি তুই? ছেলের মুখের দিকে অবিশ্বাসের দৃষ্টি মেলে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় হরিমতি দাসী। হরিমতি নামটি এখন হারিয়ে গেছে কালের গহ্বরে। আলাদা কোন পরিচিতি নেই আজ তার। এখন সে শুধুই জুড়োনের মা।

: কচ্চি যে, তুমারে আর ইন্ডিয়া পর্যন্ত টানে নিয়ে যাতি পারতেচি নে, মা। তুমারে নিতি গিলি তুমার নাতি-নাতনিগের আর বাঁচাতি পারবান না। আরও একটু শক্ত হয়ে ওঠে জুড়োন মণ্ডলের কণ্ঠ।

ভয়ে আতঙ্কে হিম হয়ে যায় জুড়োনের মা। ভুল শোনে নি তাহলে সে! কিন্তু বিশ্বাস করতে পারে না কিছুতেই।

জুড়োন তার পেটের ছেলে। স্বামী মারা গেছে সেই কবে, মনেও পড়ে না আজ। জুড়োন তখন মাত্র দেড় বছরের। অবোধ সেই শিশুকে বুকে আঁকড়ে বিধবা হরিমতি শুরু করেছিল জীবনযুদ্ধ। কোনদিকে তাকায় নি। নিজের সাধ আহ্লাদ সবকিছু বিসর্জন দিয়ে পরের বাড়িতে ধান ভেনে, খেয়ে না খেয়ে তিলে তিলে বড় করেছে ছেলেটাকে। দশ মাস দশ দিন গর্ভে ধরা সেই সন্তান কিনা আজ তাকে অজানা অচেনা এই রাস্তায় ফেলে চলে যেতে চাইছে!

কি খাবে সে! কোথায় থাকবে, কে দেখবে তাকে? বুক কেঁপে ওঠে হরিমতির। কথা সরে না তার মুখে।

লক্ষ মানুষের মিছিল। অজগর সাপের মতো এঁকেবেঁকে এগিয়ে চলেছে। গ্রামের পর গ্রাম পার হয়ে, আলের পাশ কেটে, হালট বেয়ে পিঁপড়ের সারির মতো এগিয়ে চলেছে শরণার্থীরা। বুকের মধ্যে অজানিত ভয়, শঙ্কা। ছুটছে তারা অনাহারে, অর্ধাহারে জীবন বাজি রেখে। পেছনে তাড়া করে আসছে পাক হানাদার বাহিনী, তার দোসর রাজাকার, আলবদররা। ঘর-সংসার সব মাথার পোটলা-পুটলির ভিতর। হাতে ধরা স্ত্রী, কোলেপিঠে বাচ্চাকাচ্চা। চলেছে নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, শিশু-কিশোর… কেউ হাঁটছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে, কেউ বা পা টেনে টেনে। লক্ষ্য তাদের একটাই বর্ডার, ইন্ডিয়ার বর্ডার, ভারতের সীমান্ত।
পরনে নোংরা, মলিন পোশাক। মাথার চুলে জমাট বাঁধা ময়লা। উদভ্রান্ত চোখ মুখ, উৎকণ্ঠায় দিশাহারা। প্রখর রোদের তেজে কপাল বেয়ে ঝরে পড়ে ঘাম। ক্লান্তিতে পা ভেঙ্গে আসে। কিন্তু উপায় নেই বিশ্রাম নেবার। দলছুট হতে পারবে না কেউ। দিনের আলোয় যতখানি এগিয়ে যাওয়া যায়, ততটাই মঙ্গল। দুপুরের দিকে একবার থামবে তারা কোন একটা সুবিধাজনক স্থানে। যেখানে মাথার উপর থাকবে ছায়া, হাতের কাছে জল আর জ্বালানি খড়ি।

জুড়োন মণ্ডল পথে নেমেছে সাত দিন আগে। পাক মিলিটারি পুড়িয়ে দিয়েছে তার বাড়ি। রাজাকাররা লুট করে নিয়ে গেছে সবকিছু। বৃদ্ধা মা, স্ত্রী আর তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে রওনা হয়েছিল ফরিদপুরের বিল সিংহনাথ থেকে। সারাদিন পোটলা-পুটলি মাথায় নিয়ে পথ চলা। সন্ধ্যা নামার আগেই রাতের জন্য মাথা গোঁজার ঠাঁই খোঁজা। কখনও স্কুল ঘরের বারান্দায়, কখনও খোলা মাঠে, গাছতলায়। এমন কি বৃষ্টিঝরা রাত কাটিয়েছে তারা কাঁথামুড়ি দিয়ে ওয়াপদা রাস্তার উপর। বয়সের ভারে ন্যুজ্ঝ হরিমতি। কাঁখে বড় একটা পোটলা নিয়ে ছেলে আর নাতি-নাতনির হাত ধরে খুড়িয়ে খুড়িয়ে এতটা পথ এসেছে সে। দুই তিন দিনের মধ্যেই হয়তো বর্ডার পার হয়ে পৌঁছে যাবে নিরাপদ আশ্রয়ে।

মাথার উপরে গনগনে সূর্য। প্রখর উত্তাপে ঘেমে নেয়ে একসারা। খাবার ফুরিয়ে গেছে তাদের। অনাহারে, অর্ধাহারে পুকুর, ডোবা, খাল, বিলের দুষিত জল খেয়ে রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ছে দলে দলে। কলেরা ছোঁয়াচে রোগ। লক্ষ মানুষের এই যাত্রায় শ্রান্ত, ক্লান্ত, অনাহার ক্লিষ্ট মানুষগুলোর মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে তারচেয়েও দ্রুত গতিতে। শুরু হয়ে গেছে মড়ক। বর্ডার যত এগিয়ে আসছে, আক্রান্তের হার বাড়ছে ততই বেশি।

ধুঁকছে নারী, পুরুষ, শিশু, কিশোর। রাস্তার পাশে শুয়ে কাতরাচ্ছে। এগিয়ে যাচ্ছে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে। তাদেরকে ফেলে চলে যাচ্ছে স্বজনরা। স্বামী স্ত্রীকে ফেলে, ছেলে তার বাবা-মাকে ফেলে। মৃত্যুকালে তাদের শিয়রে নেই কোন উদ্বিগ্ন মুখ। কপালে নেই কোমল হাতের পরশ। মুখে এক ফোঁটা জল দেবারও নেই কেউ।

রাস্তার পাশে, খাদের কিনারে, বটগাছের শিকড়ে পড়ে আছে মানুষের লাশ। সে সব অতিক্রম পা টেনে টেনে এতদূর এসেছে হরিমতি। রাস্তায় পড়ে থাকা দুর্ভাগা মানুষগুলোর কষ্ট দেখে মন কেঁদেছে তার। ভগবানের উদ্দেশ্যে দুই হাত তুলে প্রণাম জানিয়ে বলেছিল – অশেষ কৃতজ্ঞতা তুমার চরণে। এইরম মা অন্ত প্রাণ ছাওয়াল দিছো তুমি আমারে।
সেই মা অন্ত প্রাণ ছেলে জুড়োন আজ তাকে ফেলে রেখে চলে যেতে চাইছে!
হরিমতি ডাইনে তাকায়, বাঁয়ে তাকায়। চারিদিকে শুধু লাশ আর লাশ। পচন ধরতে শুরু করেছে লাশে। পচা বীভৎস গন্ধ ছড়াচ্ছে চারিদিকে। পঙ্গপালের মতো ঝাঁকে ঝাঁকে ভনভন করছে মাছি। আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে শকুন। বিপন্ন হরিমতি কি করবে বুঝে উঠতে পারে না।

: তালি মা, আমরা চললাম। এই ন্যাও সের খানেক চাল আর ডাল তুমার জন্যি রাহে গ্যালাম। সব তো ফুরোয়ে গেচে। বেশি কিছু দিয়ে যাতি পারলাম না।

: চাল ডাল চাবা চাবা খাব আমি? অসুস্থ মানুষডারে এরম করে ফ্যালা থুয়ে যাসনে রে বাপ।

: চিন্তা কোরে না মা। বর্ডার পার করে উগার থুয়েই আমি আসে তুমারে নিয়ে যাবানে।

: তুগার পায় ধরি, এরম কাম করিস নে। এট্টু পেট গরম অইচে দেহে বাহ্যি আর বমি করিচি দুইবার। সাতে সামান্য জ্বর। তাই দুব্বল হয়ে পড়িচি। কলেরায় তো ধরে নাই। তালি আমারে ফ্যালা থুয়ে যাবি ক্যা? হাতখান এট্টু ধরে নিলিই চলে যাবার পারবানে। এ জাগায় এহেলা পড়ে থাকলি রাত্তিরি শিয়েল কুহুরি ছিঁড়ে খায়ে ফেলা দিবেনে আমারে। হাহাকার করে উঠে হরিমতি।

: কী করব, কও মা। ভেদ বমি শুরু হয়ে গেছে চারদিক। মানুষ মরে সাফ হয়ে যাচ্ছে। যত তাড়াতাড়ি পারা যায়, সরে পড়তি হবি এ জাগার তে। কিন্তু, তুমারে ঘাড়ে করে নিতি গিলি সিতা হবেন না। তাই কচ্চি, তুমি এহানেই থাহো। আমি তাড়াতাড়ি আসে পড়বানে।

: এ কতা মুক দে বার করলি ক্যাম্বা? আমি না তোর মা। জন্মদাতা মা। বুহির দুধ খাওয়াইয়ে মানুষ করিচি তোরে। সেই মা রে ফেলায়ে থুয়ে চলে যাচ্ছিস?

: হ মা। বাধ্য হয়ে থুয়ে যাচ্চি তুমারে। আর তো কোন উপায় দেকতেচি নে।
অন্তরাত্মা কেঁপে উঠে হরিমতির। সে বুঝে ফেলে, জুড়োন যা বলছে, তাই করতে যাচ্ছে। কাকুতি মিনতি করে কাঁদতে শুরু করে বুড়ি। তাতেও কোন কাজ হচ্ছে না দেখে হাউমাউ করে ব্যাটার বৌ এর পা জড়িয়ে ধরে সে।

: আমারে আর পাপের ভাগি করবেন না মা। কী করব কন। আপনারই তো নাতি-নাতনি। তাগের যুদি বাঁচতি না দ্যান, তালি আপনের বংশ রক্ষা হবি ক্যাম্বা? টান মেরে পা ছাড়িয়ে নিয়ে জুড়োনের বৌ বলে।

ভরাপরা। মুহি পুকা পড়বি তোর। পথেই যদি ফেলা থুয়ে যাবি, তালি এ পর্যন্ত টানে আনলি ক্যা? স্বামীর ভিটে আঁকড়ায়ে পড়ে থাকতাম। নরকেও ঠাঁই হবিনে তুগার। দাদুভাই দেকতেচো, তুমার বাপ-মা কী পাষণ্ড। তুমি আমারে নিয়ে যাও দাদুভাই। খালি এট্টু হাতখান ধরবা। তালিই হাঁটে চলে যাতি পারবানে আমি। তুমার পায় ধরি দাদুভাই। কাঁদতে থাকে হরিমতি বুড়ি।

বাবা, ঠাম্মারে ফেলায়ে থুয়ে যাবা ক্যা। নিয়ে চলো সাতে করে। আমি ঘাড়ে করে নিয়ে যাবানে।

অকূলে যেন কূল পায় হরিমতি। কিন্তু জুড়োন তাল কেটে দেয় দিল সাথে সাথেই।
সিডা সম্ভব হলি কি জম্মদাত্রী মারে ফেলাইয়ে থুয়ে যাতাম? প্যাটের সন্তানের উপর তুমি তো আর রাগ করে থাকতি পারবান না। তাই করজোরে মাপ চায়ে নিলাম। নিজগুণে ক্ষমা করে দিও জননী। কোঁচার খুটে চোখ মুছতে মুছতে বলে জুড়োন।
হরিমতি বুঝতে পারে, তার আর কোন আশা নাই। অন্য পথ ধরে সে।
তোরে আামি অভিশাপ দেব। কঠিন অভিশাপ। মার অভিশাপ ঠিকই ফলে যাবি। তোর ছাওয়ালও তোরে ভাগারে ফ্যালাইয়ে দিবি। শিয়েল কুহুরি ছিড়ে খাবি তোরে। ভগমান আছে মাথার পর।

: মা, আপনেরই তো ছাওয়াল। এরম করে অভিশাপ দেবেন না। জুড়োনের বৌ বলে।

: কী কলি লো খানকি মাগি। ও আমার কিসির ছাওয়াল! আগে যুদি জানতাম, তালি জন্মের কালেই মুহি নুন দিয়ে মারে ফেলাতাম। তুইও মরবি মাগি। ভেদ বমি হবি তোর। মুহির মদ্যি রক্ত উঠে মরবি।

: অভিশাপ দ্যাও মা। ইডাই আমার পাওনা। যে সন্তান তার মারে ফেলাইয়ে থুয়ে চলে যায়, তার তো অভিশাপই পাওনা।

জুড়োন মণ্ডল গাট্টি-বোচকা, ছেলে-বৌ নিয়ে উঠে রওয়ানা দেয়। মাটিতে হাত থাবড়ে হাহাকার করে কাঁদতে থাকে হরিমতি। তার আর্ত চিৎকারে বাতাস ভারি হয়ে উঠে। পথ চলতি শরণার্থীরা সহানুভুতির দৃষ্টিতে বুড়ির দিকে তাকায়। কিন্তু থামে না কেউ। পাশ কাটিয়ে চলে যায় বর্ডারের দিকে। নিজের জীবন বাঁচাতে ব্যস্ত সবাই। দ্রুত মৃত্যুর উপত্যকা পার হয়ে যেতে চায় তারা।

হাঁটতে শুরু করে জুড়োন মণ্ডল। সে চলে যাচ্ছে জন্মদাত্রী মাকে রাস্তায় ফেলে। হরিমতির আর্তনাদে হৃদয় বিদীর্ণ হয় তার। কিন্তু থামে না সে। কলেরা ছোঁয়াচে রোগ। কলেরায় আক্রান্ত রোগীকে টেনে নিয়ে যাওয়ার অর্থ হলো নিজের ছেলেমেয়ের জীবন বিপন্ন করা। জগতের নিয়ম অতীত নয়, ভবিষ্যৎ রক্ষা করা। অতীতের ভিতের উপর ভবিষ্যতকে প্রতিষ্ঠা করা।

পেছন ফিরে আর তাকায় না জুড়োন। ধুতির খোটায় চোখ মুছতে মুছতে মিশে যায় ছুটে চলা শরণার্থীর মিছিলে…

 

সুধাংশু শেখর বিশ্বাস

জন্ম ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার প্রত্যন্ত বিলের মধ্যে মধুপুর গ্রামে। পড়াশুনা  করেছেন অর্থনীতিতে এমএ। বিসিএস ১৯৮৪ ব্যাচের সহকারী সচিব হিসেবে কর্মজীবন শুরু। মাঠ পর্যায়ে ছিলেন ইউএনও, এডিসি ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আরডিএ, বগুড়ার পরিচালক। কাজ করেছেন উপ-সচিব, যুগ্ম-সচিব হিসেবে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে। অবসর নিয়েছেন অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে। সরকারি কাজে ঘুরেছেন বহু দেশ। অবসর জীবন কাটে ঘোরাঘুরি আর লেখালিখি করে।

প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা আঠারো। ভ্রমণ কাহিণি-৬ (সাগিনো ভ্যালি, হোটেল সিয়াম, মস্কোর ঘন্টা, হোয়াইট চ্যাপেল, ঘুরে দেখা আমেরিকা),

ছোটগল্প-১ (স্ট্যাটাস),  

গবেষণা গ্রন্থ-১ (বিলের জীবনঃ নমশূদ্রদের বার মাসের তের পার্বণ), ২ নমসপুত্র আর ৩ নমস উপাখ্যান। এই দু’টি গ্রন্থের জন্য  তিনি অত্যন্ত সুপরিচিত। 

কিশোর উপন্যাস-১ (সুরুজ দ্য গ্রেট) স্মৃতিগল্প-৩ (সোনালী ডানার চিল- শৈশব, কৈশোর, যৌবন)।

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top