সুধাংশু শেখর বিশ্বাসের রম্য গল্প: ছাতু

অবশেষে ছাতুর মাহাত্ম্য যথাযথভাবেই উপলব্ধি করলেন রশিদ সাহেব। বুঝলেন প্রোটিন আর ভিটামিন এর জন্যে ভূট্টার ছাতুর কোন বিকল্প নেই।

রশিদ সাহেব ছাপোষা কেরাণি। আসলে টাইপিষ্ট। কাজ করেন ফুড গোডাউনে। সারাদিন কেটে যায় নানা ধরণের চিঠিপত্র টাইপ করে। ফুড অফিসে বাড়তি ইনকামের অলিগলি অনেক। সেসব অলিগলি রশিদ সাহেবেরও জানা। কিন্তু, রশিদ সাহেবের পরিচিতি নিতান্ত ভাল আর সৎ মানুষ হিসেবে। কোন ফন্দি ফিকির করেন না। তাই ঘুষ ঘাষ যেসব পার্টি দেয়, রশিদ সাহেবকে তারা হিসেবের মধ্যেই ধরে না।

বড় সাহেবের পিয়ন নসু মিয়া সম্ভবতঃ এ কারণেই তাকে খানিকটা বাড়তি সমীহ করে। প্রায়ই সে শুভাকাঙ্খী হিসেবে রশিদ সাহেবকে বোঝানোর চেষ্টা করে- স্যার, সারাজীবন এরম করে চললি তো না খায়ে মারা পড়বেন। এট্টু আট্টু ইদিক সিদিক না করলি কাচ্চা বাচ্চা মানুষ করবেন কিরম করে?

বড় ছেলেটার কাল এসএসসি পরীক্ষার ফর্ম ফিল আপ। টাকার জোগাড় হয় নি। সেই চিন্তা মাথায় নিয়ে বড় স্যারের গুরুত্বপূর্ণ একটা চিঠি টাইপ করতে বসেছেন রশিদ সাহেব। কিন্তু ভুল হয়ে যাচ্ছে বারবার। আবার নতুন করে শুরু করছেন। টাইপ মেশিনের খটাখট শব্দে মাথা ধরে গেছে।
বারবার তাগাদা দিয়েও কোন লাভ হচ্ছে না দেখে বড় সাহেব নিজেই উঠে এলেন। বললেন- কি হল রশিদ সাহেব, দেরি হচ্ছে কেন?
এই তো স্যার। চিঠিটা এগিয়ে ধরেন তিনি।
এ কী! এত ভুল কেন? এমন তো হয় না আপনার। কোন সমস্যা?
না স্যার। বিব্রত রশিদ সাহেব।
শরীর ঠিক আছে তো?
জ্বী স্যার।
তাহলে! বিস্মিত বড় সাহেব।
আজ উনার মনডা বড় উদাস স্যার। মাথার ঠিক নাই। সুযোগটা নিয়ে নিল নসু মিয়া।
কেন কি হয়েছে? বড় সাহেবের জিজ্ঞাসু দৃষ্টি।
স্যার, কাল উনার বড় ছেলের পরীক্ষার ফর্ম ফিল আপ। কিন্তু টাকার জোগাড় হয় নাই। সেই চিন্তায় কামে ভুল করতেচেন বারবার।
তাই নাকি! কত টাকা লাগবে?
লজ্জায় লাল হয়ে ইতস্ততঃ করতে লাগলেন রশিদ সাহেব। কি বলবেন বুঝতে না পেরে তোতলাতে শুরু করলেন।
ঠিক আছে, ঠিক আছে। বলতে হবে না। নসু মিয়া আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে উনাকে দিয়ে দাও তো। আর খোঁজ নিয়ে দেখ, রশিদ সাহেবের সংসারের অবস্থাও নিশ্চয়ই বাড়ন্ত। যা যা লাগে বাসায় পাঠিয়ে দিও।
জ্বি স্যার। এখনই ব্যবস্থা করতেচি। সোৎসাহে বলল নসু মিয়া।
রশিদ সাহেব, আমরা সবাই আপনাকে অত্যন্ত পছন্দ করি। যখন যা দরকার হয়, নসুকে বলবেন। লজ্জা করবেন না। এখন তাড়াতাড়ি চিঠিটা ঠিক করে নিয়ে আসেন তো। বড় সাহেব তার রুমে ঢুকে গেলেন।

কৃতজ্ঞতায় রশিদ সাহেবের চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল।
ছেলের পরীক্ষার ফর্ম ফিল আপ হয়ে গেছে। বাড়তি হিসেবে তার বাসায় এক বস্তা ছাতু আর কেজি দশেক চিনি দিয়ে গেছে নসু মিয়া। অনেক আপত্তি করেছিলেন রশিদ সাহেব। কিন্তু নসু মিয়া কর্ণপাত করে নি।

আমি তো হুকুমের দাস। বড় সাহেবের নির্দেশ না মানে আমার কি উপায় আছে! চাকরিডা কি খোয়ায়ে ফেলাব? তয় ছাতুডা কিন্তুক বড়ই সোয়াদ, ম্যালা ভাইটামিন। বাচ্চাগের সকাল-বিকাল নাস্তায় খাওয়াবেন। স্বাস্থ্য ভাল থাকপি, শরীরি বল পাবি।
কিন্তু এটা কি ভাল হল নসু মিয়া?
ভাল-মন্দ বিচার করার আমি-আপনি কিডা? সবই আল্লাপাকের ইচ্ছা। দার্শনিকের সুরে বলে নসু মিয়া। আপনি ঘুষও খান নাই, কারো কাছের তে চায়েও নেন নাই। বড় সাহেব পাঠাইচেন। না নিলি তো তিনি মাইন্ড করবেন। বড় সাহেব কইচেন গোডাউনে নতুন চাল আসলি এক বস্তা পাঠায়ে দিতি।
না না। স্যারকে বোলো তার আর দরকার নাই।
সে পারলি আপনি যায়ে কন গে, আমি কতি পারব না। ছোট মুহি কি বড় কতা মানায়? নির্লিপ্ত কন্ঠ নসু মিয়ার।
রশিদ সাহেব এখন ভাল আছেন। টেনশন কমেছে অনেকখানি। ছাতুর মাহাত্ম্য একটু একটু করে ছেলেরাও বুঝে ফেলেছে।
ভাইয়া দ্যাখো তো শক্ত হয়েছে কি না? ছোটকু তার মাসল ফুলিয়ে বলল।
বাঃ ভালই তো! দ্যাখ্ তো আমারটা কেমন?
সুপার! তবে মেঝো ভাইয়ারটা আরো সুন্দর!
ওরটা তো হবেই। ছাতুও খায় ব্যায়ামও করে।
সুঠাম দেহের অধিকারী মেঝো ছেলে। সকালে জগিং করে এসে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। বডি ভাঁজ করে নানাভাবে ঘুরিয়ে দেখে। খবরের কাগজের আড়ালে সেদিকে চেয়ে মুচকি মুচকি হাসেন রশিদ সাহেব। বড় ভাল লাগে। সকালে আর রাতে মহা উৎসাহে ছাতু খাচ্ছে বাসার সবাই।

রশিদ সাহেব দুপুরেও ছাতু চালু করে দিলেন। বাজার টাজার করার ঝামেলা আর রইল না। চাল-ডাল, মাছ-তরকারি কেনার অহেতুক টেনশনও নেই। একেবারে মুক্ত পুরুষ তিনি।
বুঝলি, স্বাস্থ্যই সম্পদ। স্বাস্থ্য ভাল তো শরীর ভাল। শরীর ভাল তো মন…
ঠিকই বলেছেন আব্বা। ছাতুর মাজেজা আরো আগেই বোঝা উচিৎ ছিল। বডিটা অনেক শক্ত হয়ে যেত।
আরে পাগল, আগে জানলে কি আমিই দেরি করতাম! নসু মিয়াই না বুঝিয়ে দিল ব্যাপারটা।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়েন রশিদ সাহেব। ছাতুর মর্ম তাহলে বুঝে গেছে এরাও।

শুধু খুতখুত করেন গিন্নি। চোখের পানি ফেলে বলেন- এমনই পোড়া কপাল আমার! ছেলেমেয়েদের মুখে একমুঠো ভাতও তুলে দিতে পারি না। কেমন বাবা তুমি?
শুরু হয়ে গেল ন্যাকা কান্না। একেই বলে মেয়ে মানুষের বুদ্ধি। শরীর ভাল রাখতে গেলে দরকার প্রচুর ভিটামিন আর প্রোটিন। পাবে কোথায়? না ছাতুর মধ্যে। ভাতে কি পাবে? শর্করা ছাড়া তো কিছু না। ভাত খেলে হবে পেট মোটা। বাড়বে মেদ। এজন্যেই তো ভেতো বাঙালীর কোন উন্নতি হয় না। বসে বসে ঝিমায় খালি।
নিকুচি করি তোমার স্বাস্থ্যের। মুখের স্বাদ বলেও তো একটা কথা আছে।
স্বাদ নিতে গেলে স্বাস্থ্য পাবে না। কষ্ট করতে হবে, বুঝলে গিন্নি। কষ্ট না করলে কি কেষ্ট মেলে? আগে বাচ্চাদের শরীর, বুঝলে না! ছাতু খাওয়াতে হবে বেশি বেশি করে।
অবুঝ বাচ্চাদের এইভাবে ফাঁকি দিচ্ছ, ধর্মে সইবে না। বাড়িতে চাল কবে আনবে সেটা আগে বল।
হবে হবে। বড় সাহেব বলেছেন শিগগিরই এক বস্তা চাল পাঠিয়ে দেবেন।
রশিদ সাহেব আশা করেছিলেন সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই চাল বাসায় চলে আসবে। কিন্তু পার হয়ে গেল আরো কয়েক সপ্তাহ। নসু মিয়া যেন বেমালুম ভুলেই গেছে বিষয়টা। লজ্জায় তাকে কিছু বলতেও পারেন না। যদি আবার লোভী মনে করে বসে!

আজকের দুপুরটা অন্যরকম। ছোটকুর পেটে ব্যথা। বদহজম। সাথে জ্বর। ডাক্তার সাহেব খুবই রাগ করে বললেন- আজেবাজে কি সব খাইয়েছেন ছেলেকে!
ওষুধে পেটব্যাথা কমেছে। বদহজম সেরে গেছে। ছেলে অনেকটা সুস্থ এখন। ডাক্তার পথ্য দিয়েছেন নরম ভাত আর ধনেপাতা দিয়ে মাগুর মাছের হালকা ঝোল।
ভাত রান্না হচ্ছে। ফুটছে হাঁড়িতে টগবগ করে। ফোটা ভাতের মিষ্টি গন্ধে ম্ ম্ করছে চারদিক।

মাছ রান্না হয়ে গেছে আগেই। পিঁড়ি পাতা মেঝেতে। সেই পিড়িতে আয়োজন করে বসেছে ছোটকু। ছোট বোনটা জোর করেই পাশে বসে গেছে। সবার ছোট হিসেবে এই অধিকার নিশ্চয়ই তার আছে। তাদেরকে ঘিরে গোল হয়ে বসে আছে বাকি সবাই।

মা ভাত বেড়েছেন থালায়। ফ্যানগলা গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে চতুর্দিকে। মেঝোর পেট চোঁ চোঁ করতে লাগল। বড়র গলার মধ্য সুরসুর। দুজনেই একসাথে বলে উঠল- মা আমারও জ্বর। আমিও ভাত খাব।
তোদের বাবাকে গিয়ে বল। আমার কাছে ঘ্যানঘ্যান করিস কেন? মুখ ঝামটা দেন মা।
না মা। ভাত খাব। আমরাও ভাত খাব।
যা পিড়ি নিয়ে এসে বসে পড়। একমুঠো করে তোদেরকেও দিই।
দু’ভাই আনন্দে লাফাতে লাফাতে পিড়ি আনতে ছোটে।
একটু দূরে বসে নির্মোহ দৃষ্টি মেলে মেঘশুন্য আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন রশিদ সাহেব। জগৎ সংসার সবই অসার। সবই মায়া! এই গভীর তত্ত্ব উপলব্ধি করে বড় একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে তিনি ফিরে তাকান। ছেলেমেয়েরা খেতে বসেছে। অপার আনন্দে হৈ হৈ করছে তারা।

সুখ উপচে পড়া মুখে মা বললেন- থাম তোরা। ভাল করে বস। নইলে কিন্তু পাবি না।
থালায় থালায় ভাত বেড়ে দিচ্ছেন তিনি। গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত। কুন্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া উঠছে উপরের দিকে। সেদিকে তাকিয়ে শুকনো নির্লিপ্ততা মুখে ঝুলিয়ে আপন মনেই বলে ফেলেন রশিদ সাহেব- আমার গা টাও কেমন যেন ম্যাজম্যাজ করছে গিন্নি…

 

সুধাংশু শেখর বিশ্বাস

বিসিএস ১৯৮৪ ব্যাচের কর্মকর্তা। সহকারী সচিব হিসেবে কর্মজীবন শুরু। মাঠ পর্যায়ে ছিলেন ইউএনও, এডিসি ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আরডিএ, বগুড়ার পরিচালক। কাজ করেছেন উপ-সচিব, যুগ্ম-সচিব হিসেবে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে। অবসর নিয়েছেন অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে। উচ্চতর পড়াশুনা করেছেন লন্ডনে। প্রশিক্ষণ, সেমিনার, সরকারি কাজে ঘুরেছেন ইউরোপ, আমেরিকা, অষ্ট্রেলিয়া, এশিয়ার বহু দেশ।

অবসর জীবন কাটে ঘোরাঘুরি আর লেখালিখি করে। লিখেছেন নমশূদ্র সম্প্রদায়ের জীবনধারা নিয়ে গবেষণাধর্মী উপন্যাস ‘নমসপুত্র’। পেলেন উচ্ছ্বসিত প্রশংসা। লিখলেন মুক্তিযুদ্ধের অজানা অধ্যায় নিয়ে ‘শরণার্থী’, গণ জাগরণ মঞ্চ নিয়ে ‘দ্রোহের দীপাবলি’। লিখে চলেছেন একের পর এক উপন্যাস, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, স্মৃতিগল্প, ভ্রমণ কাহিনী।জন্ম ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার প্রত্যন্ত বিলের মধ্যে মধুপুর গ্রামে। বাবার কর্মসূত্রে শৈশব, কৈশোর কেটেছে খুলনা, যশোর, বরিশাল এলাকার বিভিন্ন জেলায়। স্কুল জীবন থেকেই যুক্ত ছিলেন ছাত্র রাজনীতি এবং ‘উদীচী’ ‘খেলাঘর’ এর মতো সংগঠনের সাথে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্সসহ মাস্টার্স করেছেন অর্থনীতি বিষয়ে।
প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা পনের। উপন্যাস (৪)- নমসপুত্র, নমস উপাখ্যান, শরণার্থী, দ্রোহের দীপাবলি। ভ্রমণ কাহিনী (৬)- ম্যাকেলিনা, হোটেল সিয়াম, সাগিনো ভ্যালি, ঘুরে দেখা আমেরিকা, হোয়াইট চ্যাপেল, মস্কোর ঘন্টা। গবেষণা গ্রন্থ (১)- বিলের জীবন: নমশূদ্রদের বার মাসের তের পার্বণ। ছোটগল্প সংকলন (১)- স্ট্যাটাস। স্মৃতিকথা (৩)- সোনালি ডানার চিল (শৈশব), সোনালি ডানার চিল (কৈশোর), সোনালি ডানার চিল (যৌবন)।

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top