ইউ. জী. কৃষ্ণমূর্তির সাথে কথোপকথন: ১

দেহকে দেহের মতোই থাকতে দাও

বাংলা অনুবাদ: নান্নু মাহবুব

[…তাঁর মূল প্রশ্নের অন্তর্ধান, ‘এর কোনো উত্তর নেই’─এই আবিষ্কার, সেটা ছিল একটা শারীরবৃত্তীয় ঘটনা। ইউ.জী. বলেন, “ভেতরের একটা আকস্মিক ‘বিস্ফোরণ’ যেন আমার শরীরের প্রত্যেকটি কোষ, প্রত্যেকটি স্নায়ু, প্রত্যেকটি গ্রন্থি বিধ্বস্ত করে দিচ্ছে।” ওই ‘বিস্ফোরণের’ সাথে সাথে, চিন্তার একটা ধারাবাহিকতা, একটা কেন্দ্রবিন্দু, একজন ‘আমি’-কর্তৃক চিন্তার সংযুক্তিকরণ, ওইসব আর সেখানে নেই।]

ইউ.জী. কৃষ্ণমূর্তিকে সংজ্ঞায়িত করা কঠিন। তিনি অবশ্যই কোনো ধর্মীয় গুরু নন। তাঁকে তথাকথিত দার্শনিক বা চিন্তাবিদ বলাটাও সঠিক হবে না। যদিও ব্যাপকভাবে তিনি একজন গুরুবিরোধী (anti-guru) হিসেবে চিহ্নিত।

এই অগ্নিকল্প ঋষি মনুষ্যচিন্তাজাত সবকিছুকেই অস্বীকার করেন। তিনি বলেন যে, “চিন্তা একটা মৃত কিছু। এটা এমন কিছু যা কখনোই কোনো জীবন্ত কিছু স্পর্শ করতে পারে না।”

ইউ.জী. একটা ‘সহজ স্থিতি’র (natural state) কথা বলে থাকেন। তাঁর সমস্ত সংলাপ জুড়ে মূলত এই ‘সহজ স্থিতি’র বর্ণনাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

[ওই ‘বিস্ফোরণের’ পরের পুরো সপ্তাহ জুড়ে ইউ.জী. তাঁর ইন্দ্রিয়ের ক্রিয়াপদ্ধতিতে মূলগত পরিবর্তন লক্ষ করলেন। সাত দিনের দিন তাঁর শরীর ‘একটা দৈহিক মৃত্যু প্রক্রিয়া’র (নির্বিকল্প সমাধি) মধ্যে দিয়ে গেল, এবং সমস্ত পরিবর্তনটা স্থায়ী হয়ে গেল।]

ইউ.জী.’র (উপ্পালুরি গোপাল কৃষ্ণমূর্তি) জন্ম ১৯১৮ সালের ৯ জুলাই, দক্ষিণ ভারতের মছলিপট্টনামে। মৃত্যু ২০০৭ সালের ২২ মার্চ, ইতালির ভলেক্রোসিয়া শহরে। ১৯৬৭ সালে ৪৯ বছর বয়সে সুইজারল্যাণ্ডের সানেনে তাঁর মিউটেশন ঘটে। যে ঘটনাকে তিনি ‘দুর্দৈব’ বলে উল্লেখ করেন।

১৯৬৭ সালের পর থেকে তাঁর সংলাপের ভিত্তিতে The Mystique of Enlightenment, Mind is a Myth, The Courage to Stand Alone, Thought is Your Enemy এবং No Way Out গ্রন্থগুলি প্রকাশিত হয়। পরে এই গ্রন্থগুলি প্রায় সমস্ত ইউরোপীয় ভাষায়, চীনা এবং জাপানী ভাষাসহ রুশ, কোরীয় এবং ভারতের বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তাঁকে নিয়ে লেখা অন্যান্য গ্রন্থের সংখ্যা ইতিমধ্যে পঞ্চাশ ছাড়িয়েছে।

এটি ‘No Way Out’ গ্রন্থের ‘Leave the body alone?’ পর্বটির বাংলা অনুবাদ। একজন চিকিৎসকের সাথে তাঁর আলাপচারিতা। ─না.মা.

০ ০ ০

সাক্ষাৎকারগ্রাহক: তুমি যেখানেই যাও লোকজন বোধহয় তোমার আচার-আচরণ আর চেহারা নিয়ে মন্তব্য করে। অথচ আমি জানি তুমি কোনো যোগাভ্যাস করো না, কোনোরকম শরীরচর্চাও করো না।

ইউ.জী.: কোনোরকম শরীরচর্চাই করি না। হাঁটি শুধু আমার বাসা থেকে পোস্ট অফিস পর্যন্ত, সেটা আমার বাসা থেকে আধা কিলোমিটার বা সিকি মাইল মতো হবে। তবে একসময় আমি প্রচুর হাঁটতাম।

মনে পড়ছে বছর বিশেক আগেও তুমি অনেক হাঁটতে। তোমার একটা বইয়ে তথ্যটা পড়েছি।

আগের সমস্ত হাঁটাহাঁটির জন্যে আমাকে হয়তো বড় কোনো মূল্য দিতে হবে। না, ঠাট্টা নয়, এইসব নিয়ে মন্তব্য করার মতো যথেষ্ট যোগ্য আমি নই। তবে একটা ব্যাপার আমি জোর দিয়ে বলতে চাই তা হলো, যেকোনো কারণেই হোক এই দেহ আমাদের কাছ থেকে কিছুই শিখতে বা জানতে চায় না। কোনো সন্দেহ নেই চিকিৎসাবিজ্ঞানে আমরা বিশাল উন্নতি করেছি। কিন্তু তাতে কি আসলেই দেহের কোনো উপকার হচ্ছে? সেটা মৌলিক প্রশ্নগুলির মধ্যে একটা, যা আমাদের করা দরকার।

সেই প্রশ্নটাই আমাদের সর্বক্ষণ করা দরকার। আমরা কি সত্যিকার অর্থে দেহকে কোনো সহায়তা করতে পারি?

আমরা আসলে যা করি তা হলো, যাকে আমরা কোনো ব্যাধি বলি সেই ব্যাধিটার লক্ষণগুলোর চিকিৎসার চেষ্টা চালাই। কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো, এবং আমি সবসময় যথেষ্ট যোগ্য যারা─চিকিৎসক, তাদের কাছে এই প্রশ্নটাই করি, সুস্থতা কী? ব্যাধি কী? এই দেহের জন্যে ব্যাধি বলে কি কিছু আছে? দেহ জানে না এটা সুস্থ না অসুস্থ। তুমি জানো, [দেহের] কোনো ‘গোলযোগকে’ বর্ণনা করে আমরা এটাই বোঝাতে চাই যে দেহের স্বাভাবিক ছন্দের ভারসাম্যে কিছু বিঘ্ন ঘটেছে। এমন নয় যে আসলে দেহের ছন্দটা কী আমরা জানি। অথচ আমরা এতো আতঙ্কিত যে তক্ষুণি কোনো ডাক্তারের কাছে বা যাদেরকে আমরা এসব বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মনে করি, আমাদেরকে সাহায্য করতে পারবে বলে মনে করি, তাদের কাছে দৌড়াই। যে পরিস্থিতির ভেতর নিজেদেরকে দেখছি, সেই পরিস্থিতিসৃষ্ট সমস্যার সমাধানের কোনো সুযোগ আমরা দেহকে দিই না। নিজেকে সামাল দেবার জন্যে যথেষ্ট সময় আমরা দেহকে দিই না। কিন্তু আসলে সুস্থতা কী? তুমি একজন ডাক্তার, তোমার কাছে আমার প্রশ্ন, সুস্থতা আসলে কী? দেহ কি জানে, বা দেহের কি জানার কোনো উপায় আছে যে এটা সুস্থ না অসুস্থ?

আমরা জানি। কোনো ব্যাধিলক্ষণ থেকে মুক্ত থাকাটাকে আমরা সুস্থতা বলি। যদি আমার হাঁটুতে কোনো ব্যথা না থাকে তাহলে আমার হাঁটুতে কোনো ব্যাধি নেই। কার্যকর জ্ঞানার্জনের জন্যে আমরা চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবেষণা নিয়ে মেতে থাকি যাতে করে সেই জ্ঞানটা হাঁটুর ব্যথা হলে প্রয়োগ করা যায়।

কিন্তু ব্যথা কী? আমি কোনো আধিবিদ্যক প্রশ্ন করছি না। আমার কাছে ব্যথা একটা নিরাময় প্রক্রিয়া। কিন্তু [দেহের] নিজেকে নিরাময় বা সুস্থ করতে, বা যেটাকে আমরা ব্যথা বলি তার থেকে নিজেকে মুক্ত করতে আমরা দেহকে যথেষ্ট সুযোগ বা সময় দিই না।

তুমি বলতে চাচ্ছো, আমরা যাকে ‘ব্যথা’ আখ্যা দিই, সেটা থেকে দেহের পরিত্রাণে আমরা যথেষ্ট সময় অপেক্ষা করি না। আমরা মনে করি ব্যথা ক্ষতিকারক, তারপর এর সমাধানে সর্বত্র ছুটোছুটি করি।

আমরা আতঙ্কিত, দেখ। মারাত্মক কিছু ঘটবে এই ভয়ে আমরা আতঙ্কিত।

এবং ওইখানেই আমরা প্রতারিত হওয়ার মতো সহজসরল হয়ে যাই। এবং কিছু জালিয়াত আর বাণিজ্য সেটার ফায়দা লোটে।

যাবতীয় এইসব বাণিজ্য এরই সুযোগ নিচ্ছে। জনগণের সারল্য, বিশ্বাসপ্রবণতা তারা পুঁজি করছে। এই কথা বলছি না যে তোমার কোনো ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিৎ নয় বা কোনো ওষুধের সাহায্য নেওয়া উচিৎ নয়। যারা বিশ্বাস করে, যে অসুখই হোক, প্রার্থনাই হবে দেহের নিরাময়ে একমাত্র সহায়ক বা ঈশ্বরই হবেন নিরাময়কারী, আমি তাদের কেউ নই। সেরকম কিছুই না। ব্যথা দেহের জৈবিক কর্মকাণ্ডের অংশ, আর কিছু নয়। এবং এই দেহের রসায়নে আমাদের ভরসা রাখতে হবে বা নির্ভর করতে হবে, এবং দেহ সবসময়ই আমাদেরকে কোনো-না-কোনো সতর্কসঙ্কেত দিচ্ছে। প্রথম দিকে আমরা অবহেলা করি, কিন্তু দেহের সামলানোর পক্ষে যখন এটা অনেক বড় হয়ে ওঠে, তখন হয় উদ্বেগ আর আতঙ্ক। এ বিষয়ে অন্যদের থেকে বেশি জানে এমন কারো কাছে গিয়ে সাহায্য নেওয়াটা হয়তো আমাদের জন্যে জরুরী। সেটুকুই আমরা পারি। রোগীকে কোনো সহায়তা দেওয়া যেতেই পারে। গতানুগতিক বা বিকল্প, যে চিকিৎসাই হোক, সবই রোগীর বর্ণিত লক্ষণের ভিত্তিতে করা হয়।

সেটা ঠিক।

তো দেখ, এটা যদি কোনো শারীরিক সমস্যা হয়ে থাকে, তাহলে এটা একটা যান্ত্রিক সমস্যা।

হ্যাঁ, তবে আজকালকার নতুন চিকিৎসাভাবনায় চিকিৎসকদের রোগীর কথায় খুব-একটা কান না দিয়ে তাদেরকেই পরীক্ষা করে দেখতে বলা হয়। তবে আমার মনে হয় সেটা একটা ভুল যেহেতু কেউ যদি জানে তো রোগীই সেটা জানে।

কিন্তু সে তোমাকে যেটা বলছে, তার উদ্বেগের কারণে সেটা সর্বদাই অতিরঞ্জিত হয়ে যাচ্ছে।

সেটা সত্যি।

তবে একই সঙ্গে তোমার তার কথার ওপর নির্ভর না করেও কোনো উপায় নেই। কেউ যদি বলে যে তার এই এই ব্যাপার─তোমাকে তার কথামতোই এগুতে হচ্ছে।

কিন্তু যখন তুমি মানুষকে শিক্ষিত করে তুলছো, কীভাবে শরীরকে সহায়তা করতে হয় সে-বিষয়েও তাদেরকে ধারণা দিচ্ছো এবং সেটা তাদেরকে তাদের যন্ত্রণার সময় অনেক দুর্ভাবনা থেকে রক্ষা করছে।

তুমি কি বলতে চাও ডাক্তাররা এইসব সমস্যার ঊর্ধ্বে? ডাক্তারদের অন্যদের থেকে বেশি সহায়তা দরকার।

ডাক্তারদেরও হাঁটুতে ব্যথা।

ডাক্তারদের প্রতি আমার পরামর্শ হলো তারা আগে নিজেদের নিরাময় করুক। খুবই আশ্চর্য ব্যাপার হলো বহু হৃদরোগ-বিশেষজ্ঞের মৃত্যু হয়েছে হার্ট এ্যাটাকে।

হ্যাঁ, এর ওপর কিছু গবেষণা হয়েছে। মনোচিকিৎসকদের আত্মহত্যার প্রবণতা প্রায়শই অন্যদের থেকে বেশি, এটা খুবই লক্ষণীয় একটা ব্যাপার।

তাদেরই বেশি মনোচিকিৎসার প্রয়োজন।

হৃদরোগ-বিশেষজ্ঞদেরই বেশি হৃদরোগ জানো তো?

অবশ্যই। ভারতে একটা কথা আছে সাপুড়েকে সাপেই দংশাবে এবং তাতেই তার মৃত্যু হবে। এটা খুবই অদ্ভুত। বহুকাল সাপ নিয়ে খেলা করে সে পার পেয়ে যেতে পারে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত গোখরো বা অন্য কোনো জাতের সাপের দংশনেই তার মৃত্যু হবে।

মূল সমস্যাটা হলো দুর্ভাগ্যক্রমে যন্ত্রণাকে আমরা শারীরিক এবং মনস্তাত্ত্বিক দুইভাগে ভাগ করেছি। আমি যেভাবে দেখি, মনস্তাত্ত্বিক যন্ত্রণা বলে আদৌ কিছু নেই। আছে শুধু শারীরিক যন্ত্রণা।

যারা স্নায়ুচাপে ভোগে, দুশ্চিন্তায় ভোগে, তাদের কী হবে? ভ্যালিয়ামই বোধহয় এই দেশে সবচে’ বেশি নির্দেশিত ওষুধ।

এটা তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। শারীরিক যন্ত্রণা যখন অসহ্য হয়ে যায় এবং তোমার এ অবস্থা থেকে নিজেকে মুক্ত করার আর কোনো উপায় থাকে না, তখন দেহ অচেতন হয়ে যায়। এই অচেতন দশায়, দেহের যদি তখনও নিজেকে পুনর্নবায়িত করে স্বাভাবিকভাবে ক্রিয়াশীল হবার কোনো সম্ভাবনা থেকে থাকে, তাহলে সে নিজেকে সাহায্য করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে। যদি সে অক্ষম হয়, সেখানেই কাহিনির সমাপ্তি। তো যন্ত্রণা আসলে যতটা, তার চেয়ে বেশি তীব্র মনে হয়, কারণ আমরা যাবতীয় এইসব যন্ত্রণার সংবেদন সংযুক্ত করি আর তাতে ধারাবাহিকতা দিই। তা নইলে যন্ত্রণা যতটা তীব্র বলে ভাবছি, সেটা ততখানি নয়। আরেকটা সমস্যা হলো দেহকে আমরা নিরাময়ের কোনো সুযোগ দিই না। শুধু মোড়ের ওষুধের দোকানে বা কোনো ডাক্তারের কাছে দৌড়াই আর ওষুধ কিনি। এই একটা ব্যাপার বোধহয় দেহের পক্ষে তার নিজস্ব পন্থায় তার সমস্যা মোকাবিলা করাটা কঠিন করে তুলছে।

যন্ত্রণার মুখোমুখি হলে সাধারণ মানুষ কোনো একটা সহজ রাস্তা নেবার চেষ্টা করে।

সহজ রাস্তা একটা আছে যেহেতু তোমার শল্যচিকিৎসার দারুণ উন্নতি হয়েছে।

আসলে তুমি যেমন বলছিলে, শল্যচিকিৎসায় বা ওষুধে লোকেদের দেহে ক্ষত হতে পারে। শল্যচিকিৎসা কখনো কখনো সমস্যাটাকে মারাত্মক করে তোলে।

সকল শল্যশুদ্ধি দেহের স্বাভাবিক ছন্দের বিঘ্ন ঘটায়। আমি মোটেও বলছি না যে শল্যচিকিৎসার ক্ষেত্রে যে বিশাল উন্নতি হয়েছে তুমি তার সুবিধা নেবে না। আমাদের সকলেরই যে মৌলিক প্রশ্নটা করা উচিৎ─“কেন এবং কীসের জন্যে আমরা জীবন দীর্ঘায়ু করতে এতো উদ্গ্রীব?” এখন তাঁরা [বিজ্ঞানীরা] বলছেন পঁচাশি বছরের বেশি আমাদের পক্ষে বাঁচা সম্ভব। প্রত্যেক ভারতীয়ের যা লক্ষ্য, একশ বছর বাঁচার স্বপ্ন, সেটা সত্যি হয়েছে। সেখানে কারো সাথে দেখা হলেই সে তোমাকে “শতায়ু হও” বলে আশীর্বাদ করবে। কিন্তু এতকাল তারা সফল হয় নাই। ক্বচিৎ কখনো দু’একজন। সমস্ত সাধু, ঋষি আর মানবজাতির পরিত্রাতাদের আশীর্বাদ সত্ত্বেও শত শত বৎসর ধরে ভারতীয়দের গড় আয়ু সাড়ে তেইশ বৎসরই থেকে গেছে। কিন্তু যে কারণেই হোক হঠাৎ সেটা এক লাফে তেপান্নর কিছু বেশি হয়ে গেছে।

কারণটা কী?

উন্নতমানের খাদ্যটাই হয়তো কারণ।

মৃত্যুহারও কমেছে। কিন্তু পরিণত বয়সের লোকেরা এখনও দীর্ঘজীবী হয়নি।

সবকিছুরই পরিসংখ্যানে আমরা খুব গুরুত্ব দিই। কিন্তু পরিসংখ্যান কারো মতামতের পক্ষে বা বিপক্ষে দুইভাবেই ব্যবহার করা যায়।

তোমার আরেকটু ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে কথা বলি। কখনো কখনো তোমার সাথে খেতে বসে দেখেছি তুমি আশ্চর্যরকম কম খাও। আমি বলতে চাচ্ছি, তুমি যেটুকু খাও সেটা কোনো মানুষের গড় খাদ্যগ্রহণের তুলনায় অস্বাভাবিকরকম কম। এখন লোকজন বলছে যে কম আহার স্পষ্টতই আয়ুষ্কাল বাড়ায়। পশুদের ক্ষেত্রে তারা এইটা আবিষ্কার করেছে।

বয়স বাড়ার সাথে সাথে খাদ্যগ্রহণের মাত্রা কমাতে হয়। আমরা তা করিনা কারণ আমাদের খাদ্যাভ্যাসের ভিত্তি ভোগ ছাড়া আর কিছু নয়। আমরা ভোগের জন্যে খাই। খাওয়া আমাদের জন্যে একটা ভোগসাধন কর্ম।

নানা ধরনের খাবারে লোকজনের আগ্রহ।

সেজন্যে প্রত্যেক টেলিভিশন শো’তে আমি খুব খারাপ এই মন্তব্যটা করি যে, যদি তুমি নানা ধরনের খাবার পছন্দ করো তবে নানা ধরনের নারীও গ্রহণযোগ্য। সেটা অসামাজিক কাজ হতে পারে, কিন্তু আমার কাছে গ্রহণযোগ্য─ নানা ধরনের নারী, নানা ধরনের পুরুষ! [হাসি] দেহের প্রয়োজনের অতিরিক্ত আমরা খাই। সেটা একটা মূল বিষয়, যা আমাদের বুঝতে হবে। অতিরিক্ত খাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। আমি খুব কম খাই। আমার অনেক বন্ধু ছিলেন, বড় বড় পুষ্টিবিদ, শিকাগোতে তাঁরা আমার প্রতিবেশী ছিলেন। যেকোনো কারণেই হোক সবসময়ই আমি প্রচুর ক্রিম নিই─দ্বিগুণ, তিনগুণ, চারগুণ ক্রিম বা যা-ই বলো। সেটাই আমার মূল খাদ্য। সবসময়ই তাঁরা আমাকে সতর্ক করতেন, “এই যে বন্ধু, আমরা ভীষণভাবে চাই তুমি বেঁচেবর্তে থাকো, কিন্তু এইভাবে [ক্রিম খেলে] তোমার কলেস্টরোলের সমস্যা হবে। এতে-ওতে তুমি মরবে।” কিন্তু আমি এখনো বেঁচে আছি, এবং তাঁরা সবাই প্রয়াত। আমি বলি যে ফ্যাট খায় ফ্যাট। [হাসি] তো যাই হোক, এটা [এই ধরনের আহার] আমি কাউকে সুপারিশ করছি না।

তুমি প্রতিদিন কতটুকু ক্যালরি নিচ্ছো জানো তো? দিনপ্রতি হয়তো ছয়শো থেকে সাতশো ক্যালরি।

আমি তেয়াত্তর বছর বেঁচে আছি, তাই না?

তুমি দুর্বলও নও। তোমাকে বেশ শক্তসমর্থই লাগে।

খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, একুশ বছর বয়স থেকে আমার ওজন একশ পয়ত্রিশ পাউণ্ডই রয়ে গেছে। কি খাই বা না খাই এটা কখনো পাল্টায়নি। সেজন্যে আমি সবসময়ই জোর দিয়ে বলি, এবং সেটা হয়তো তোমার কাছে খুবই হাস্যকর শোনাবে, কাঠের গুঁড়ো আর শিরিসের আঠা খেয়েই তুমি জীবনধারণ করতে পারো। শিরিসের আঠা শুধু খাবারটাকে সুগন্ধিত করার জন্যে!

কখনো কখনো এটা খুবই সুস্বাদু…নিঃসন্দেহে… [হাসি]

কারি পাউডার বা আর-সমস্ত মশলা না নিয়ে খানিকটা শিরিসের আঠা নিলে আর কি! [হাসি] যাই হোক সেটা বাড়াবাড়ি হয়ে যায়, কিন্তু তারপরও বন্দিশিবিরে-থাকা লোকেদের কখনো স্বাস্থ্যসমস্যা হয় নাই, এটা সত্যি।

বন্দিশিবিরে এইরকম ব্যাপার বারবার দেখা গেছে। ভিয়েতনামে আমেরিকান যুদ্ধবন্দিরা সুস্থই ছিল।

ঠিক তাই। তো এটা হয়তো খুবই হাস্যকর আর উদ্ভট শোনাচ্ছে কিন্তু বছরের পর বছর বন্দিশিবিরে-থাকা এইসব লোকেদের যখন আমেরিকা আর পশ্চিম ইউরোপের মতো দেশগুলোতে নিয়ে যাওয়া হলো, তারা যখন এইসমস্ত খাবারদাবার খেল, তাদের কেবলই স্বাস্থ্যসমস্যা হতে লাগলো। এত্থেকে আমি অবশ্য কোনো সরলীকরণ করছি না।

কোনো বিশেষ খাবারেও তোমার আসক্তি নেই। আসল কথা হলো তুমি খাও খুবই অল্প।

খুবই অল্প। তবে এই খাদ্যাভ্যাস আমি মোটেও কাউকে সুপারিশ করছি না। সবার জন্যেই প্রযোজ্য হবে এমন কোনো ধরাবাঁধা নিয়মনীতি নেই। এই সমস্ত পুষ্টিবিদ আর ডাক্তারদের প্রতি আমার পরামর্শ হবে তারা যেন বিষয়টা আরেকবার ভাবেন এবং এই মানবদেহের কর্মকাণ্ডকে ভিন্নভাবে দেখেন। তবে সেক্ষেত্রে অবধারিত সত্য বলে ধরে-নেওয়া আমাদের বহু ধারণা জলাঞ্জলি দিতে হবে।

 নিঃসন্দেহে সেটা জরুরি।

খুবই জরুরি। কিন্তু ওষুধ শিল্পে যাদের বিপুল বিনিয়োগ আর, এখানে এবং সারা বিশ্বে যারা চিকিৎসাবিদ্যা সমিতিতে রয়েছেন, স্বভাবতই তাঁরা এই প্রস্তাবের বিপক্ষে যাবেন। বিষয়গুলো আমাদের ভিন্নভাবে দেখা দরকার। ভালো না লাগলেও এই মূল পরিস্থিতিটা আমাদের মেনে নিতে হবে যে আমাদের এই দেহ, যা কিনা হাজার হাজার বছরের বিবর্তনের ফল, যেকোনো পরিস্থিতিতে টিকে থাকার মতো যথেষ্ট ধীশক্তি তার রয়েছেই। তার আগ্রহ শুধু টিকে থাকায় আর বংশবিস্তারে। এই দেহের কাছে এই প্রাণীটির ওপর চাপানো যাবতীয় সাংস্কৃতিক ইনপুটের [সংস্কৃতি-প্রবিষ্ট বিষয়াদি] কোনো মূল্যই নেই। সত্যিই এটা আমাদের কাছ থেকে কিছুই শিখতে চায় না। এই অবস্থায়, এর আরো দীর্ঘ, সুখী, স্বাস্থ্যবান জীবনের জন্যে আমরা যা-কিছু করছি─তা শুধু এর সমস্যাই সৃষ্টি করছে। আমি সত্যিই জানি না কতদূর এইসব চলতে পারে।

তুমি বলছো─এক্ষেত্রে যা-কিছুই আমরা করছি সবই কোনো-না-কোনোভাবে দেহের আরো স্বাস্থ্যবান, সুখী, দীর্ঘজীবী হবার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছে। সুতরাং দেহকে অবশ্যই তার মতোই থাকতে দিতে হবে।

হ্যাঁ, দেহকে তার মতোই থাকতে দাও। ভয় পেও না এবং নানান জায়গায় দৌড়াদৌড়ি কোরো না। কোনো অবস্থাতেই তোমার মৃত্যুকে জয় করার কোনো উপায় নেই।

তোমার কথা বুঝতে পারছি। অবচেতনে মানুষ মৃত্যুকে প্রতিরোধ করতে চায়।

আমরা যে মানুষকে একটা নৈতিক মূল্যবোধে ঠেলে দিই সেটা খুবই অবাঞ্ছিত একটা ব্যাপার, তাই না? সবাইকেই তুমি কোনো নৈতিক মূল্যবোধে ঠেলে দিতে চাও। শত শত বছর ধরে আমাদের সযত্ন-লালিত যে নৈতিক মূল্যবোধ, সেটাই আমাদের দুর্দশার জন্যে দায়ী কিনা, আমরা কখনো সেই প্রশ্ন তুলি না।

হ্যাঁ, হয়তো ব্যাধি সৃষ্টি করছে সেটাই।

সেটাই আমাদের জীবনে ব্যাধি আর দ্বন্দ্ব। সত্যিই আমরা জানি না। আরেকটা ব্যাপারে আমি জোর দিতে চাই তা হলো, আমরা যাকে পরিচিতি বলি, ‘আমি’, ‘তুমি’, ‘কেন্দ্রবিন্দু’, ‘মন’─, এগুলো কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট। আদৌ এর অস্তিত্ব নেই।

এটা একটা সাংস্কৃতিক ব্যাপারও বটে।

হ্যাঁ, এটা সাংস্কৃতিকভাবে সৃষ্ট। এই পরিচিতিটা বজায় রাখতে আমরা সম্ভাব্য সবকিছুই করে যাচ্ছি, তা সে আমরা শয়নে-স্বপনে-জাগরণে যে অবস্থাতেই থাকি না কেন। এই পরিচিতিটা রক্ষায় যে অস্ত্রটা আমরা ব্যবহার করছি সেটা শক্তিশালী, অভেদ্য হচ্ছে এবং এর ধারাবাহিকতা বজায় থাকছে। স্মৃতির অবিরাম ব্যবহার তোমাকে অবসন্ন করে দিচ্ছে। আমরা আসলেই জানি না স্মৃতি কী, অথচ আমাদের ওই অস্তিত্বহীন পরিচিতি রক্ষার্থে আমরা অবিরাম এটা ব্যবহার করে যাচ্ছি।

তুমি বলছো, আমরা যে একটা স্বতন্ত্র সত্তা, নিজেদেরকে সেটা স্মরণ করিয়ে দিতেই আমরা সারাক্ষণ আমাদের স্মৃতি ব্যবহার করে যাচ্ছি।

স্মৃতি কী, আমরা সত্যিই এই প্রশ্নের উত্তর জানি না, এবং কেউই এর নির্দিষ্ট এবং নিশ্চিত কোনো উত্তর দিতে পারেন নাই। তুমি বলতে পারো এটা সম্পূর্ণতই নিউরোন [স্নায়ুকোষ], কিন্তু পরিচিতি বহাল রাখতে আমরা সারাক্ষণই এই স্মৃতি ব্যবহার করে চলেছি।

স্মৃতি আজ একটা বড় সমস্যা যেহেতু আক্ষরিক অর্থেই লোকেরা সেটা হারাচ্ছে।

সেটা হলো আমরা যাকে বলি আলঝাইমার্স ব্যাধি; এবং সেটাই মানবজাতির ভবিতব্য হতে চলেছে। নিজেকে ভাঁওতা দিয়ে তুমি সবাইকে বলতেই পারো যে এ্যালুমিনিয়ামের বাসনকোসন, এইসবই… আলঝাইমার্স ব্যাধির কারণ।

কিন্তু তুমি সেটাকে মানবজাতির ভবিতব্য বলছো কেন?

কারণ এটা [স্মৃতি] বিপুল পরিমাণ শক্তিক্ষয় করে চলেছে।

প্রত্যেকে সর্বক্ষণ অবিরাম স্মৃতি ব্যবহার করে চলেছে।

নির্দিষ্ট পরিমাণ স্মৃতির ব্যবহার নিঃসন্দেহে জরুরী; কিন্তু অনন্তকাল বাঁচা, শক্তসমর্থ থাকা, আরো স্বাস্থ্যবান থাকায় এর প্রয়োগ সৃষ্টি করবে জটিলতা।

কিন্তু তোমাকে বাড়ি ফেরার কথা মনে রাখতে হবে, এবং সেজন্যে তোমাকে স্মৃতি ব্যবহার করতে হবে।

সেটা এই প্রাণীরই অংশ। সেটা রয়েছেই। পশুদের ওই ধরনের স্মৃতি রয়েছে।

ঠিক, একটা পশু জানে কীভাবে তার বাড়ি ফিরতে হবে। কিন্তু তুমি ওই ধরনের স্মৃতির কথা বলছো না।

না। ওইটাই [যে স্মৃতি আমাদের পরিচিতি রক্ষা করছে] আমাদের সবাইকে মানসিক রোগী বানিয়ে তুলেছে। ওইটার অবিরাম ব্যবহার মানবজাতির ট্রাজেডি হতে চলেছে। এই অতিব্যবহারের ফলে জীবনযাপনের সমস্যা মোকাবিলায় আমাদের আর যথেষ্ট শক্তি নেই। এটা বিপুল পরিমাণ শক্তিক্ষয় করে। কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে আমরা যে বিপদের মুখোমুখি হতে চলেছি তা থেকে আমাদের মুক্ত হবার পথ বাৎলে দেবে এমন কোনো ধরাবাঁধা নিয়মনীতিও নেই।

তাহলে এক অর্থে তুমি বলতে চাইছো যে স্মৃতি অনেকটা পেশির মতো, অতিব্যবহারে যা অবসন্ন হয়ে যাচ্ছে। অবিরাম ব্যবহারে এটা অবসন্ন হয়ে যাচ্ছে।

হ্যাঁ। আমি বলি যে স্নায়ুতন্ত্রে কোনো স্নায়বিক গোলমাল আছে।

এই যে আমাদের প্রচুর সংখ্যা মনে রাখতে হয়, বিপুল পরিমাণ তথ্য মজুদ করতে হয়, সেই অসন্তোষের কথা বলছো?

কম্পিউটারের সহায়তা নিয়ে এখন আমাদের স্মৃতির [ওই উদ্দেশ্যে] ব্যবহার কমিয়ে আনাটা সহজ।

তোমার তাই মনে হয়? কিন্তু কম্পিউটার বোধহয় সমস্যাটাকে আরো জটিলই করে দিয়েছে। সত্যিকার অর্থে সেটা মানুষের কোনো কাজে লাগছে না।

বোধহয় লাগছে। আমার একটা ওয়ার্ড-ফাইণ্ডার আছে যেটা খুবই কাজের। একটা সময় আমাদের শব্দকোষ মুখস্থ করতে হতো, সংস্কৃত সমার্থক-শব্দকোষ, এইসমস্ত। কিন্তু আজ আর সেসবের দরকার নেই। তুমি শুধু একটা বাটন টিপবে আর মেশিনটা বলবে, “খুঁজছি,” এবং একটু পরেই সে তোমাকে শব্দার্থটা বলে দেবে, সাথে সাথে সেটার ব্যুৎপত্তিগত অর্থ এবং বানান। ওইসমস্ত তথ্য মুখস্থ রাখার চাইতে এই ধরনের মেশিন ব্যবহার করাটা অনেক সহজ। শিগগিরই [ওই সমস্ত উদ্দেশ্যে] স্মৃতির ওপর আমাদের নির্ভরতা অপ্রয়োজনীয় হয়ে যাবে।

নিঃসন্দেহে সেটা আমাদের বিপুল সমস্যা থেকে মুক্তি দেবে।

যেকোনো সময় তুমি তোমার চাকরিটা হারাবে!

সেটা ভালোই হবে…

সমস্ত লক্ষণ বিশ্লেষণ করে কম্পিউটারই যেহেতু বলে দেবে কী করতে হবে….। রোবট বিশেষজ্ঞ-সার্জনের জায়গা নেবে এবং অস্ত্রোপচার করবে। আমি বলবো ওইরকম ঘটনা ঘটার আগেই তোমার উচিৎ হবে যথেষ্ট টাকাপয়সা কামিয়ে অবসর নিয়ে নেওয়া। [হাসি]

তুমি বলছিলে দেহকে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে দেখা উচিৎ। এখন তাঁরা [বিজ্ঞানীরা] পিনিয়াল গ্রন্থির দিকে নজর দিতে চাইছেন।

ভারতে তাঁরা সেটাকে বলেন আজ্ঞা চক্র। আমরা ওইসব সংস্কৃত শব্দ ব্যবহার করতে চাই না।

বছর বিশেক আগে আমেরিকায় তাঁরা বলতেন এই গ্রন্থির কোনো প্রয়োজন নেই। এখন তাঁরা দেখছেন এই গ্রন্থি থেকেই আসলে…

এইসব গ্রন্থিবিষয়ক তাদের সমস্ত ধারণা আর অভিমত পাল্টানো দরকার। পরিচিতি রক্ষার্থে স্মৃতির (যা হলো চিন্তা) এই অবিরাম ব্যবহারের ফলে এইসব অনেক গ্রন্থি, যা এই প্রাণীটির কর্মকাণ্ডের জন্যে অত্যন্ত জরুরি, সেসব সুপ্ত, জড় বা নিষ্ক্রিয় হয়ে আছে। ধর্মীয় ব্যাপারে আগ্রহী কিছু মানুষ সেসব সক্রিয় করার চেষ্টা করে আর মনে করে তারা কোথাও পৌঁছে যাচ্ছে। কিন্তু ভারত বা এরকম কোনো দেশ থেকে আমদানি-করা পদ্ধতিতে সেসবের কোনো একটাকে জাগ্রত করতে চাইলে, সেটা বিপজ্জনক হতে পারে। সেসব [ওইসব পদ্ধতি] সমগ্র স্নায়ুতন্ত্র বিধ্বস্ত করে দিতে পারে। উপকার হওয়ার বদলে সেসব তোমাকে দিতে পারে একটা ‘সুখোচ্ছাস’[high]। এইসব গ্রন্থি নিয়ে খেলা করার একটা বিপদ হলো, এই দেহকে স্বাভাবিকভাবে, সুস্থভাবে, বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ক্রিয়াশীল থাকতে দেবার বদলে আমরা হয়তো এর ক্ষেত্রে নতুন কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে ফেলবো। বিপদটা এইখানে।

সেটা [এই গ্রন্থিগুলি জাগ্রত করার চেষ্টা] কোনো-না-কোনোভাবে একটা সম্পূর্ণ ধারাবাহিক সমস্যা সৃষ্টি করবে।

হ্যাঁ। যেমন ধরো পিটুইটারি গ্রন্থি। তারা বলেন (আমি নিজে জানি না) এটা দেহের উচ্চতার জন্যে দায়ী। এই গ্রন্থিটিকে ম্যানিপিউলেট [সুদক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ] বা সক্রিয়ণ করতে গিয়ে তুমি লম্বা হয়ে যেতে পারো।

ঠিক তাই, তখন তুমি গ্রোথ হরমোন [পরিপুষ্টি হরমোন] পাচ্ছো।

হ্যাঁ, গ্রোথ হরমোন। গবেষক বিজ্ঞানীদের জন্যে ওই জাতীয় জিনিস নিয়ে মেতে থাকাটা ঠিক আছে, সমাজ থেকে তারা যথেষ্ট পুরস্কৃত হবেন। কিন্তু আসলে তাতে আমাদের কোনো উপকার হচ্ছে কিনা আমরা সেটা জানি না। এইসব জিনিস নিয়ে যথেষ্ট গবেষণা হয় নাই, আর সেসব নিয়ে তাড়াহুড়া করে কিছু করাটা খুবই বিপজ্জনক হতে পারে।

পিনিয়াল গ্রন্থির ব্যাপারে তোমার কী মনে হয়?

সেটাই সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থি। সেই কারণেই সংস্কৃতে তাঁরা এটাকে বলেন আজ্ঞা চক্র।

চিন্তার দ্বারাই এটা ক্ষতিগ্রস্ত, তারপরও এর পরীক্ষা-নিরীক্ষায় তাঁরা চিন্তা প্রয়োগ করে যাচ্ছেন।

হ্যাঁ। চিন্তার দ্বারাই এটা ক্ষতিগ্রস্ত। তাঁরা সফল হবেন না। তাঁরা হয়তো এটা নিরাময়ের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করবেন বা…

কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ যেটা করছে তাতে আসলে তাদের পিনিয়াল গ্রন্থির ক্ষতিই হচ্ছে।

ঠিক তাই। স্বাভাবিকভাবে জাগ্রত হলে, চিন্তার সার্বক্ষণিক হস্তক্ষেপ ছাড়াই এই গ্রন্থি এই দেহের কর্মকাণ্ডের দায়িত্ব নেবে এবং নির্দেশনা দেবে─

তাহলে আমরা আবার সেইখানেই ফিরে আসছি যে চিন্তা স্বয়ংই হলো শত্রু , অনুপ্রবেশকারী।

এটা আমাদের শত্রু । চিন্তা একটা রক্ষণাত্মক প্রক্রিয়া, এই প্রাণীটির বিনিময়েও এটা নিজেকে রক্ষায় আগ্রহী।

তুমি বলছো চিন্তা জিনিসটাই মানুষের দুশ্চিন্তার কারণ।

চিন্তাই আমাদের যাবতীয় সমস্যা সৃষ্টি করছে, এবং তার নিজেরই সৃষ্ট সমস্যা সমাধানে এই অস্ত্র আমাদের কোনো কাজে লাগবে না।

……..

[অনুবাদের স্বত্ব সংরক্ষিত]

 

Facebook Comments

5 Comments

  1. Pingback: ইউ জী কৃষ্ণমূর্তির সাথে কথোপকথন: ২ » সাহিত্য ক্যাফে

  2. Pingback: ইউ.জী. কৃষ্ণমূর্তি (আত্মজীবনীপর্ব) » সাহিত্য ক্যাফে

  3. Pingback: ইউ.জী. কৃষ্ণমূর্তির সাথে কথোপকথন: ৬ » সাহিত্য ক্যাফে

  4. Pingback: ইউ.জী. কৃষ্ণমূর্তির সাথে কথোপকথন: ৭ » সাহিত্য ক্যাফে

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top