ইউ. জী. কৃষ্ণমূর্তির সাথে কথোপকথন: ২

ইউ. জী. কৃষ্ণমূর্তির সাথে কথোপকথন: ১

মায়ার সমাপ্তিই হলো মৃত্যু

বাংলা অনুবাদ: নান্নু মাহবুব

সাক্ষাকারগ্রাহক: আপনার কথা মন দিয়ে শুনে, আপনার দুইটা বই পড়ে আমার মনে হয়েছে আপনি বলতে চা কোনো অহম্ নেই, কোনো আত্মা নেই, ওইরকম কিছুই নেইআপনি বলতে চা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য দেহরূপেই জীবনসমগ্রের অস্তিত্ব

ইউ.জী.: আমাদের চারপাশের জীবন থেকে সেটা পৃথক বা স্বাধীন নয়। এটা একটাই একক। আমি কোনো নিশ্চিত বিবৃতি দিতে পারি না, তবে কোনো এককালে মানুষের ভেতরে যে আত্মচৈতন্য ঘটেছে, সেটাই আমাদেরকে চারপাশের জীবনসমগ্র থেকে পৃথক করে দিয়েছে। (বিবর্তন বলে কিছু আছে কিনা আমরা নিশ্চিতভাবে জানি না; বিবর্তন আমাদের একটা ধারণা। এইবিষয়ক বিশেষজ্ঞদের কথা আমরা মেনে নিই। নির্দিষ্ট কিছু জিনিস পর্যবেক্ষণ করে ওইসব লোকেরা যাকে বলে বিবর্তন তত্ত্ব সেইটা প্রতিষ্ঠা করেছেন।)

আপনি কি বলতে চা আমরা যে জীবনটাকে অনুভব করি সেটা শুধুই দেহের মাধ্যমে, শুধুই ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে, এবং দেহই সমগ্র মানুষটাকে ধারণ করে আছে?

‘জীবন’ বলতে আপনি ঠিক কী বুঝান? জীবন বিষয়ে কেউ কিছুই জানে না, এবং এটা সংজ্ঞায়িত করার কোনো অর্থ হয় না । জীবন নিয়ে যা-কিছু আমরা বলি সেটা শুধু আমাদের একটা জল্পনা। জীবন বা যা-কিছু আমরা বুঝার বা অনুভব করার চেষ্টা করছি, সেটা এইবিষয়ক আমাদের যে জ্ঞান রয়েছে তার মাধ্যমেই। কিন্তু চিন্তা একটা মৃত কিছু। এটা এমন কিছু যা কখনোই কোনো জীবন্ত কিছু স্পর্শ করতে পারে না। যখনই এটা জীবনকে স্পর্শ করতে চায়, ধরতে চায়, ধারণ করতে চায় এবং একে রূপ দিতে চায়, তখনই এটা জীবনের জীবনগুণে ধ্বংস হয়ে যায়। জীবন বলে আমরা যত কিছুই বুঝাই না কেন, সেটা আসলে জীবন নয়, জীবনযাপন। জীবনযাপন হচ্ছে আমাদের চারপাশের মানুষ, চারপাশের জীবন, চারপাশের সমগ্র বিশ্বের সাথে আমাদের সম্পর্ক। এবং শুধু এ-ই আমরা জানি। ওই সম্পর্ক আসলে কোনো মূলগত সম্পর্ক নয়, বরং জীবনের সাথে একাত্ম হবার আমাদের যে চাহিদা, তার থেকে সৃষ্ট একটা সম্পর্ক। সুতরাং, যা-ই আমরা করি, এর সাথে একাত্ম হতে যে-পদক্ষেপই আমরা নিই, নিষ্ফল, যেহেতু আমাদের চারপাশের জীবনের সাথে কোন সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করার কোনো উপায়ই আমাদের নেই।

আমরা এর অংশ নই বলছেন কেন?

আমি কখনোই ধরে নিচ্ছি না বা বলছি না যে আমরা এর অংশ নই। আমরা এর অংশ। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে প্রশ্নটা আমাদের নিজেদের জিজ্ঞেস করা উচিৎ, ‘‘কী আমাদের সারাক্ষণ আমাদের চারপাশের জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে? কী সেটা যা সারাক্ষণ এই বিচ্ছিন্নতা, এই বিভক্তি (যদি এই শব্দটা বলি) ধরে রাখে?’’ আসলে, যা আমাদের বিভক্ত করেছে, তা হলো চিন্তা। চিন্তা হলো বস্তু। কিন্তু সেই বস্তু সেখানে দীর্ঘক্ষণ স্থায়ী হতে পারে না। জন্ম হওয়ামাত্র বস্তু আবার শক্তির অংশ হয়ে যায়। কিন্তু আমাদের দিক থেকে, বা চিন্তার দিক থেকে, ধারাবাহিকতা ধরে রাখার এই চাহিদাটাই আমাদেরকে বারংবার একই জিনিস অনুভব করতে চালিত করে। এবং এইভাবেই আমরা আমাদের জীবন আর আমাদের চারপাশের জীবনের মাঝখানে এই বাহ্যিক, কৃত্রিম, অস্তিত্বহীন দ্বান্দ্বিকতা বা বিভক্তি বজায় রাখি।

চিন্তাকে মস্তিষ্কের কর্মকাণ্ড বলেই ধরে নেওয়া হয়মস্তিষ্কের উদ্দেশ্য কী হতে পারে? দেহ আর মনের মধ্যে বোধহয় একটা দ্বন্দ্ব রয়েছে

‘চিন্তা স্বয়ম্ভু এবং স্বতঃস্ফূর্ত’─এটা শুধু আমাদের দিক থেকে একটা অনুমান, এবং আমি বলবো, মিথ্যা একটা অনুমান। চিন্তা তা নয়। চিন্তা শুধু উদ্দীপকের প্রতি একটা সাড়া। মস্তিষ্ক আসলে কোনো স্রষ্টা নয়; এটা শুধু একটা ধারক। এই দেহে মস্তিষ্কের কাজ শুধু প্রাণীদেহের প্রয়োজনের দিকটা লক্ষ্য রাখা এবং এর সংবেদনশীলতা রক্ষা করা, পক্ষান্তরে সংবেদজ ক্রিয়াকর্মে ক্রমাগত হস্তক্ষেপ করে চিন্তা দেহের সংবেদনশীলতা ধ্বংস করে দিচ্ছে। সেইখানেই দ্বন্দ্বটা। দেহের প্রয়োজন এর সংবেদনশীলতা রক্ষা করা, চিন্তার চাহিদা প্রত্যেকটি সংবেদন ইন্দ্রিয়পর কর্মকাণ্ডের কাঠামোর মধ্যে অনুবাদ করা। দ্বন্দ্বটা এইখানেই। ইন্দ্রিয়পর কর্মকাণ্ডকে আমি নিন্দা করছি না। মন, বা যা-ই বলুন, এই ইন্দ্রিয়পরতা থেকেই তার জন্ম। তাই মনের সকল কর্মকাণ্ড স্বভাবতই ইন্দ্রিয়পর, পক্ষান্তরে দেহের কর্মকাণ্ড হলো তার চারপাশের উদ্দীপকের প্রতি সাড়া। আপনি যাকে মন বলেন সেই মন আর দেহের ভেতরকার মূল দ্বন্দ্ব আসলে সেটাই।

তাহলে আপনি বলছেন মন বা মস্তিষ্কের সত্যিকার অর্থে কোনো দিব্য লক্ষণই নেই?

আমার মনে হয় না মন বলে মস্তিষ্কের কর্মকাণ্ড থেকে পৃথক কিছু আছে।

আপনি কি বলতে চা মস্তিষ্কের কোনো দিব্য ক্রিয়াকর্ম নেই?

ইন্দ্রিয়পর কর্মকাণ্ডে এটা আগ্রহী নয়। মন যাতে আগ্রহী এবং মনের যেটা চাহিদা─সেরকম কোনো অভিজ্ঞতায় দেহের আগ্রহ নেই। এমনকি তথাকথিত আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা বা ধর্মীয় অভিজ্ঞতা─যেমন, মোক্ষ, নির্বাণ, অসীমত্ব, সুখ, এসবেও এটা আগ্রহী নয়। সুখ একটা জিনিস, দেহ যাতে আগ্রহী নয়। দীর্ঘক্ষণ সে এটা নিতে পারে না। ভোগ অন্যতম একটা জিনিস যেটা সে সর্বদাই প্রত্যাখ্যান করছে। সুখ বিষয়ে দেহ কিছুই জানে না, এমনকি জানতে চায়ও না।

সুখ শুধুই একটা চিন্তন বৈশিষ্ট্য, একটা ইন্দ্রিয়পর অভিজ্ঞতা

সুখ সেখানে একটা সাংস্কৃতিক ইনপুট। সুখ বলে কি কিছু আছে? আমি বলবো, না। কাজেই সুখান্বেষণ একটা সাংস্কৃতিক ইনপুট। দুনিয়ার সবখানে, সর্বত্র বিরাজমান, সেটাই অভিন্ন আকাঙ্ক্ষা আমরা জানি। সেটাই আমরা সবাই চাই, এবং সর্বত্রই ওই চাওয়াটাই মানুষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চাওয়া। সুখ, (এই শব্দটা যদি ব্যবহার করি) অন্য যেকোনো সংবেদনের মতোই। সুখ-সংবেদন বলি যাকে, চিন্তা নিজেকে সেটা থেকে পৃথক করামাত্রই ওই সংবেদনটিকে তার স্বাভাবিক মেয়াদ থেকে দীর্ঘক্ষণ চালু রাখার চাহিদাটা চলে আসে। তাই যেকোনো সংবেদন, যত অসাধারণই হোক, যত আনন্দেরই হোক, দেহের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত। ওই সংবেদনটিকে তার জীবৎকাল থেকে বেশি সময় ধরে রাখাটা, সংবেদজ প্রত্যক্ষণের সংবেদনশীলতা এবং এই প্রাণের সংবেদনশীলতা ধ্বংস করে দিচ্ছে। ওই যুদ্ধই সেখানে চলছে। সুখ কী না জানলে আপনি কখনোই অসুখী হবেন না।

আপনি কি বলতে চা দেহ থেকে সমস্ত মনস্তাত্ত্বিক বিষয়াদি সরিয়ে নিলে একটা মানুষ আর একটা জন্তুর মধ্যে কোনোই পার্থক্য নেই?

একদমই না। আমরা সবাই জীবজন্তুর মতো। আমরা ভিন্ন কিছু নই, আপনার রক্তশোষা ওই মশাটার থেকে মহত্তর কোনো উদ্দেশ্যেও আমরা সৃষ্ট হই নাই।

একটা মানুষ আর একটা সাধারণ সংবেদনশীল জন্তুর মধ্যে কোনো সুস্পষ্ট পার্থক্য আছে?

চিন্তাই এই গ্রহের অন্যসব প্রজাতি থেকে আমাদের আলাদা করেছে। চিন্তাই আমরা ধরে রাখতে চাই। ‘মনুষ্যমন’-সৃষ্ট যাবতীয় সমস্যার জন্যে এটাই দায়ী।

যাকে বলে শুধুই জৈবিকভাবে টিকে থাকা’ ─সে তো আছেই, কিন্তু চিন্তা কি মানুষকে ভালভাবে টিকে থাকতে সাহায্য করে নাই?

একটু আগেই যা বলছিলাম, চিন্তাই এই গ্রহের বাদবাকি অন্যসব প্রজাতি থেকে আমাদের পৃথক করেছে। চিন্তার সাহায্যেই অন্যান্য প্রজাতির তুলনায় ভালো অবস্থা সৃষ্টি করা, দীর্ঘকাল টিকে থাকা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়েছে।

কেন আমরা এই মায়ার ভেতরে থাকি, কেন নিরন্তর এই অবস্থা চলছেই?

মায়া থেকেই যায় কারণ মায়ার সমাপ্তি হলে, যাকে বলে ক্লিনিক্যাল মৃত্যু, সেটা ঘটবে। তাই একটা মায়া ত্যাগ করলে সর্বদাই অন্য একটা দিয়ে আমরা সেটা প্রতিস্থাপন করি।

কেন?

ওই জিনিসটাই আমাদের মৃত্যু নামক অনিবার্য সমাপ্তিটা জয়ের অনুভূতি দেয়। ওইটাই একমাত্র মৃত্যু। তা নাহলে আদৌ মৃত্যু বলে কিছু নেই। এবং মৃত্যু হলো মায়ার সমাপ্তি, ভয়ের সমাপ্তি, নিজেদের সম্পর্কে আর চারপাশের জগৎ সম্পর্কে আমাদের যে জ্ঞান, সেইটার সমাপ্তি।

এখন তাহলে প্রশ্ন হলোবুদ্ধিমত্তা কী? আমরা দেহের সহজাত বুদ্ধিমত্তা নিয়ে কথা বলছিলাম, যার মাধ্যমে দেহের ঐকতানিক, পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত কর্মকাণ্ড সম্পন্ন হয়কিন্তু দৈহিক ক্ষেত্র ছাড়াও কি কোনো ক্ষেত্র আছে, যেখানে বুদ্ধিমত্তার কর্মকাণ্ড আছে?

না। দেহ দেখুন কিছুই জানতে চাইছে না। কোনো কিছুই দেহ শিখতে চাইছে না। তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে যে বুদ্ধিমত্তার প্রয়োজন সেটা তার রয়েছেই। সৌভাগ্যই হোক বা দুর্ভাগ্যই হোক, যাকে বলে বুদ্ধি, আমরা সেটা অর্জন করেছি। চিন্তার ক্রমাগত ব্যবহার আর পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে আমরা এই বুদ্ধি অর্জন করেছি। এই চিন্তার সাহায্যে অন্য প্রজাতির তুলনায় দীর্ঘকাল টিকে থাকাটা সম্ভব হয়েছে। এটা, তার নিজস্ব ধরনেই, টিকে থাকার জন্যে আমরা যা গড়ে তুলেছি সেই সমগ্র কাঠামোটা ধ্বংসের কারণ। এই সত্যিটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, অর্জিত বুদ্ধি, যা আমাদের চিন্তার সৃষ্টি, আমাদেরকে অন্যান্য প্রজাতির তুলনায় দীর্ঘকাল টিকে থাকতে সাহায্য করেছে।

আপনি বলতে চাইছেন আমাদের বুদ্ধিমত্তা কোনোভাবেই জীবজন্তুর বুদ্ধিমত্তা থেকে পৃথক বা পৃথকযোগ্য নয়?

হয়তো আমাদের দেহ এবং মস্তিষ্কের কর্মকাণ্ড জীবজন্তুর তুলনায় বেশি বিকশিত। তার অর্থ এই নয় যে আমরা অন্যান্য প্রজাতি থেকে কোনোভাবে উত্তম। তাদের কথা যদি সত্যি হয়, মনুষ্যদেহ গাঠনিক উপাদানে ভাঙা হলে তার সাথে বৃক্ষের বা আপনার রক্তশোষা মশাটার কোনো পার্থক্য নেই। মূলত এটা অবিকল একই। উপাদানের অনুপাত কোনো ক্ষেত্রে বেশি, কোনো ক্ষেত্রে কম। আপনার শরীরের শতকরা আশি ভাগ জল, বৃক্ষেও শতকরা আশি ভাগ জল। তো সেইজন্যেই আমি জোর দিয়ে বলি যে, আমরা পরমাণুর দৈবিক সমাপতন ছাড়া আর কিছুই নই। যদি এবং যখন মৃত্যু ঘটে, দেহে পুনর্বিন্যাস হয় আর তারপর এইসব পরমাণু মহাবিশ্বের শক্তি সাম্যাবস্থা বজায় রাখায় ব্যবহৃত হয়। এই ব্যাপারটা ছাড়া, এই দেহের জন্যে মৃত্যু বলে কিছু নেই।

মনুষ্যমস্তিষ্ক কি বেশি সংবেদনশীল, ধরা যাক, বৃক্ষের চেয়েও?

তাদের কথা সত্যি হলে, আমিসহ আমাদের বেশিরভাগ মানুষের তুলনায় কুকুর অনেক বেশি বুদ্ধিমান।

হতে পারে

জীবজন্তু কোনো কিছু পাল্টানোর করার চেষ্টা করে না। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই ব্যাপারটা আমাদের বুঝতে হবে। নিজেদের ভেতরে একটা পরিবর্তন ঘটাতে চাওয়াটা হচ্ছে সাংস্কৃতিক ইনপুট। কী পাল্টানোর আছে? এটাই আমার মূল প্রশ্ন। আমূল বা অন্যকোনোভাবে পাল্টানোর কিছু আছে কি? কি জানি! কাজেই আমাদের নিজেদের জন্যে নিজেদেরই খুঁজে বার করতে হবে ‘‘সেখানে কী আছে? সেখানে কি কোনো সত্তা আছে? সেখানে কি কোনো অহম্ আছে? সেখানে কি কোনো ‘আমি’ আছে?’’ আমার উত্তর হলো, ‘‘না।’’ যা সেখানে দৃষ্ট এবং অনুভূত, সেটা ওই বিষয়ে আমাদের যে জ্ঞান রয়েছে─, অহংবিষয়ক জ্ঞান, ‘আমি’বিষয়ক জ্ঞান, সত্তাবিষয়ক জ্ঞান─, পুরুষপরম্পরায় যে-জ্ঞান আমাদের কাছে সঞ্চারিত হয়ে এসেছে, তার মাধ্যমে সৃষ্ট। সে সবই হলো সাংস্কৃতিক ইনপুট।

এখানে আমাদের ভেতরেদুইজন ব্যক্তিমানুষের ভেতরে, কোন যোগাযোগ নেই?

আপনার কি মনে হয় আমাদের মধ্যে কোনো যোগাযোগ আছে? আমরা কি এখানে কোনো যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছি?

নামূলত নাএটা সম্পর্কের থেকেও বেশি কিছু

না। যতক্ষণ পর্যন্ত আপনি-আমি ওই অস্ত্রটা, যা আমরা এখন পরস্পরের সাথে যোগাযোগের জন্যে ব্যবহার করছি, ব্যবহার করবো, কোনো বুঝাবুঝি সম্ভব নয়। আমার প্রত্যেকটি বক্তব্য আপনি আপনার জ্ঞানের কাঠামোর মধ্যে সর্বক্ষণ অনুবাদ করে যাচ্ছেন─সেটাকেই আমি বলি আপনার সাপেক্ষ বিন্দু।

আমরা-যে কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছি, সেটাই কি প্রমাণ করে না যে একটা শারীরিক বা শারীরবৃত্তীয় সম্পর্ক রয়েছে?

ওই সম্পর্কটা রয়েছেই। তো আমাদের জ্ঞানই আমার থেকে আপনাকে আর আপনার থেকে আমাকে আলাদা করছে। কিন্তু এখন একটা ভিন্ন মাত্রায় আমরা একধরনের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছি। অথচ সেটা করার জন্যে জ্ঞান কোনো অস্ত্র নয় এবং অন্য কোনো অস্ত্রও নেই। যদি সেটা অস্ত্র না হয় এবং যদি অন্য কোনো অস্ত্র না থেকে থাকে, তাহলে কোনো উপলব্ধিরও প্রয়োজন নেই। এটাই হলো উপলব্ধি, যা কোনোভাবে আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, বুঝার কিছুই নেই। সত্যিই আমি জানি না কীভাবে এটা ঘটলো, এবং আমার এটা জানার কোনো উপায় নেই। এটা ওই অস্ত্র নয় এবং ভিন্ন কোনো অস্ত্রও নেই─এই উপলব্ধি ঘটাতে আমার কাউকে সাহায্য করার উপায় নেই। বুঝার কিছুই নেই, এই উপলব্ধি সৃষ্টির জন্যে আমাদের কোনো অস্ত্রের প্রয়োজন নেই।

অনেক গুরুই বলেছেন আত্মা আছে, অহম্ আছে

জানি। সেইজন্যে রমণ মহর্ষির মতো ঋষিও, লোকেরা যখন তাঁকে ‘‘আমাদের কী করা উচিৎ?’’ এইজাতীয় সব প্রশ্ন করে জ্বালাতন করতো, পাল্টা প্রশ্ন করতেন─‘‘আমি কে?’’ এই প্রশ্নটাও কোনো বৌদ্ধিক প্রশ্ন নয়, কারণ আমরা উভয়পক্ষই ধরে নিচ্ছি যে, একটা ‘আমি’ আছে, যার প্রকৃতি আমাদের অজানা, এবং আমাদেরকে এর প্রকৃতি অন্বেষণ করতে হবে। আমি যতদূর বুঝি, আমি যে ‘আমি’টাকে জানি, সেটা হলো একটা সর্বনামে উত্তম পুরুষ। সেটা ছাড়া অন্য কোনো ‘আমি’, যা আপনার থেকে আমাকে পৃথক করার উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হবে, আমি খুঁজে পাই নাই, মনে হয় না কখনো খুঁজে পাবো। আমি বলি ‘আমি’ এবং ‘আপনি’।

দেহের চেতনা

দেহের চেতনার অস্তিত্ব নেই। আদৌ চেতনা বলেই কিছু নেই। অস্তিত্বহীন দেহের প্রতি সচেতন হতে যে জিনিসটা আমাদের সাহায্য করছে, সত্যি কথা বলতে কি, সেটা হলো জ্ঞান, যা আমাদের দেওয়া হয়েছে। ওই জ্ঞান ব্যতিরেকে আপনার নিজের দেহ সৃষ্টি করার এবং অনুভব করার কোনো উপায় নেই। মগ্নচৈতন্য, অবচৈতন্য, চেতনার বিভিন্ন মাত্রা, চেতনার উচ্চতর দশা, ─এসব তো পরের কথা, চেতনা ধারণাটাকেই আমি সন্দেহ করি। চেতনা বলে কোনো কিছু আমি বুঝি না। আমি এইটাতে [চেয়ারের হাতল স্পর্শ করে] সচেতন হই─শুধুমাত্র এই সম্পর্কে আমার যে জ্ঞান রয়েছে তার মাধ্যমে। জ্ঞানকাঠামোর মধ্যে অনুবাদ না করলে স্পর্শটা আমাকে কিছুই বলে না। অন্যথায় ওই স্পর্শটা অনুভব করার কোনো উপায়ই আমার নেই। যেভাবে এই ইন্দ্রিয়গুলি কাজ করে সেটা, আমাদের যেভাবে বিশ্বাস করানো হয়েছে, তার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। চোখ আপনার হাতের নড়াচড়ার দিকে তাকিয়ে আছে, সেখানে কী ঘটছে সেটা লক্ষ করা ছাড়া ওই সক্রিয়তা বিষয়ে সেটা কিছুই বলছে না।

কিন্তু আমরা তো অনুভব করছি….

না। অনুভবও একটা অনুবাদ। যে-জ্ঞান আমাদের রয়েছে সেটার সাহায্য ছাড়া স্পর্শ স্পর্শ-বিষয়ে নিজে থেকে কিছুই বলে না। এই বিষয় নিয়ে আপনার যে জ্ঞান রয়েছে সেটার সাহায্য ছাড়া, এটা ‘শক্ত’ বা ‘নরম’, এই সত্যটা অনুভব করার কোনো উপায়ই আপনার নেই। জানি না আপনি বুঝতে পারছেন কিনা।

বুঝতে পারছিকিন্তু আমার মনে হয় স্পর্শ করলে দেহেও একটা সংবেদন হচ্ছে

না। ওই সংবেদনটা হচ্ছে স্পর্শেন্দ্রিয়ের মাধ্যমে। স্মৃতি বা স্নায়ুকোষের (বা যে নামই দিন) মাধ্যমে এটা অনূদিত হলেই কেবল আপনি বলছেন এটা শক্ত নয়, নরম। ‘এটা কোনো সাধারণ স্পর্শ নয়, এটা একটা ভালবাসার স্পর্শ’─মনে মনে এইসমস্ত বলে আপনি নিজেকে ঠকাতেই পারেন। কিন্তু ওই সবই হলো এর ওপর চাপানো।

স্পর্শ নিয়ে আর কিছু বলা যায়?

একে যদি শুধুই শারীরবৃত্তীয় মাত্রায় ছেড়ে দেন, আপনার দিক দিয়ে কোনো প্রতিক্রিয়াই হবে না।

সেই দিকটা কোনটা?

সেটাই হলো দৈহিক সাড়া। সেটা অনূদিত নয়। সেটা হয়তো দেহের জন্যে একধরনের ভাল-লাগা। কি জানি! আমার বুঝার উপায় নেই সেটা কোনো ভাল-লাগার সাড়া নাকি স্পর্শের প্রতি শুধুই একটা দৈহিক সাড়া। লোকেরা যখন জিজ্ঞেস করে, ‘‘আপনি হাসেন কেন?’’ আমি বলি যে উদ্দীপকের প্রতি অন্য যেকোনো সাড়ার মতোই এটা শুধুই একটি সাড়া। ‘‘আপনি হাত নাড়ান কেন?’’ ‘‘আপনি এত অঙ্গভঙ্গি করেন কেন?’’ ─একে আপনি শুধুই অঙ্গভঙ্গি বলতে পারেন, কিন্তু যথেষ্টভাবে নিজেকে প্রকাশ করতে পারছেন না মনে করছেন বলেই হয়তো এই অঙ্গভঙ্গিগুলি রয়েছে। এইসমস্ত অঙ্গভঙ্গি করে আপনি আপনার বক্তব্যগুলো জোরালো করছেন। সেটা শুধু যোগাযোগের একটা ধরন। এইভাবেই আমরা সবাই শুরু করি, এরপর ধীরে ধীরে ভাষায় উন্নীত হই। কিন্তু তারপরও আপনার মনে হচ্ছে আপনার সঙ্গীকে যা বলতে চাইছেন সেটা ঠিক বুঝাতে পারছেন না, সেইজন্যেই, আপনার বক্তব্যের সমর্থনে, আপনার বক্তব্য জোরালো করতে আপনার নানারকম অঙ্গভঙ্গি। ভারতীয়দের একরকম অঙ্গভঙ্গি আবার আমেরিকানদের আরেকরকম অঙ্গভঙ্গি। খুব সম্ভব এইসব অঙ্গভঙ্গি বা হাতের নড়াচড়াও জিনের মাধ্যমে সঞ্চারিত হয়।

ইতালিতে একবার এক মহিলার সাথে আমার দেখা হলো। তাঁর পুত্রের জন্মের পরপরই তাঁর স্বামীর সঙ্গে তাঁর বিচ্ছেদ হয়। কুড়ি বৎসর তাদের আর দেখা হয় নাই। সেই মা আমাদের বলেছিলেন, সবসময়ই তিনি খেয়াল করতেন তাঁর পুত্রের অঙ্গভঙ্গির সাথে তাঁর স্বামীর অঙ্গভঙ্গির কোনো পার্থক্য নেই। এতে অবশ্য কিছুই প্রমাণ হয় না, তবে ইঙ্গিতটুকু পাওয়া যায় যে অঙ্গভঙ্গিও হয়তো জিনের মাধ্যমে সঞ্চারিত হয়। জানি না এক্ষেত্রে জিনের ভূমিকা কী আর কীভাবেই বা পুরো ব্যাপারটা পুরুষপরম্পরায় সঞ্চারিত হয়।

এই সমস্তকিছুর সংক্ষেপ করলে যা দাঁড়ায়, আমাদের সবকিছুই দৈহিক

এটা আমার জানার উপায় নেই। দেহকে আলাদা করে শুধুই দৈহিক সাড়ার দিক দিয়ে কথাবার্তা বলাটাও ভ্রান্তিকর হতে পারে। আমি আসলেই জানি না।

আপনি কি বস্তুবাদী?

কি জানি! লোকজন আমাকে বস্তুবাদী বলে। লোকজন তো আমাকে নাস্তিক পর্যন্ত বলে, তার কারণ শুধু এই যে, আমি বলি ঈশ্বর অবান্তর। কিন্তু তার মানে এই দাঁড়ায় না যে আমি একজন নাস্তিক। কাজেই কী ধরনের লেবেল তারা আমার ওপর সেঁটে দিচ্ছে তাতে আমার কোনোই আগ্রহ নেই। বিশ্বাস করুন আর না-ই করুন: এতে আমার কিছুই এসে যায় না। আমি আপনাকে কোনো কিছু প্রমাণ করার বা কোনো ব্যাপারে স্বমতে আনার চেষ্টা করছি না।

কোনো পরিবর্তন ঘটাতে চাওয়া এবং প্রকৃতই সেখানে যা আছে, সেটা থেকে ভিন্নরকম হতে চাওয়াটা যখন আর নেই, তখন আপনার যা রইবে সেটা এমন একটা কিছু যা আপনি কখনোই অনুভব করতে পারবেন না। সেই কারণেই আমি বলি যে আমি শুধুই একজন সাধারণ মানুষ। কিন্তু লোকেরা তাদের নিজস্ব কারণেই আমাকে একশো একটা কাঠামোতে মেলাতে চায়। আমি বলি যে আমি শুধুই সাধারণ একজন মানুষ। অথচ সবাই ভাবে আমি কোনো সাধারণ মানুষ নই।

ধন্যবাদ।

 

_________________________________
১. সাংস্কৃতিক ইনপুট: cultural input; (সংস্কৃতি-প্রবিষ্ট বিষয়াদি।)
২. ক্লিনিক্যাল মৃত্যু: clinical death; নিদানিক মৃত্যু।
৩. পরমাণুর দৈবিক সমাপতন: fortuitous concourse of atoms.
৪. শক্তি সাম্যাবস্থা: energy level.
৫. সাপেক্ষ বিন্দু: reference point; (যে বিন্দুর সাপেক্ষে কোনো কিছুর অবস্থান নির্ণয় করা হয়।)
৬. রমণ মহর্ষি: বিখ্যাত ভারতীয় ঋষি রমণ মহর্ষি (১৮৭৯-১৯৫০)।
৭. সর্বনামে উত্তম পুরুষ: first person singular pronoun.
৮. মগ্নচৈতন্য: the subconscious; (মনস্তত্ত্বে) নিজের যে চিন্তা এবং অনুভূতিতে একজন পুরোপুরি সচেতন নয়, বা মনের সেই অংশ যেখানে সেসব ঘটে।
৯. অবচৈতন্য: the unconscious; (মনস্তত্ত্বে) নিজের মানসিক কর্মকাণ্ডের যে অংশ সম্বন্ধে একজন নির্জ্ঞাত থাকে, অথচ স্বপ্ন, আচরণ ইত্যাদির নিপুণ বিশ্লেষণের মাধ্যমে যা শনাক্ত ও উপলব্ধি করা যায়; নির্জ্ঞান।

…………………..
[Conversation with U.G. Krishnamurti: 2; এটি Thought Is Your Enemy গ্রন্থের End of Illusion is Death পর্বটির বাংলা অনুবাদ। অনুবাদের স্বত্ব সংরক্ষিত।]

 

 

Facebook Comments

3 Comments

  1. Pingback: ইউ.জী. কৃষ্ণমূর্তি (আত্মজীবনীপর্ব) » সাহিত্য ক্যাফে

  2. Pingback: ইউ.জী. কৃষ্ণমূর্তির সাথে কথোপকথন: ৬ » সাহিত্য ক্যাফে

  3. Pingback: ইউ.জী. কৃষ্ণমূর্তির সাথে কথোপকথন: ৭ » সাহিত্য ক্যাফে

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top